বর্ষার প্রতি বাঙালির প্রেম-ঘৃণার দ্বন্দ্ব
বর্ষা। বাঙালির জীবনে এক অদ্ভুত অনুভূতির নাম। একদিকে বৃষ্টি মানে প্রেমের সুর, কাঁথা মুড়ি দিয়ে বই পড়ার অবসর; অন্যদিকে বর্ষা মানেই জলজট, স্যাঁতসেঁতে ঘর, এবং শেষ মুহূর্তের গৃহপালিত যন্ত্রণা। বাঙালির বর্ষার প্রতি এই প্রেম-ঘৃণার দ্বন্দ্ব যেন এক চিরন্তন রূপকথার মতো।
বর্ষা ও বাঙালির রোমান্টিসিজম
বর্ষা আসা মানেই প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে ওঠা। মেঘের গর্জন, গঙ্গার তরঙ্গ, আর সবুজ গ্রামবাংলার বুকে জলকাদায় ভিজে যাওয়া রাস্তাগুলি যেন কবিতা হয়ে ওঠে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ থেকে জসীমউদ্দীন, সবার কবিতায় বর্ষা স্থান করে নিয়েছে।
বর্ষার প্রথম দিনের বৃষ্টি মানেই চা-এর কাপে কুলকুল শব্দ, খিচুড়ি-ইলিশের জুটিতে মন মাতানো সুখ, আর জানলার শিকে বৃষ্টির টাপুর টুপুর। প্রেমিক-প্রেমিকার গল্পে বর্ষা এক চিরকালীন পটভূমি—ছাতা শেয়ার করার রোমান্টিকতা কিংবা স্রেফ ভেজা রাস্তায় হাঁটার আনন্দ।
বর্ষার দৈনন্দিন দুর্দশা
কিন্তু বর্ষা মানেই শুধু রোমান্টিকতা নয়। বর্ষা মানে ভিজে অফিসে যাওয়া, ট্রামের ভিতরে ভিড় আর ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে গাড়ির চাকার ছিটকে দেওয়া কাদা।
কলকাতার বর্ষা মানে জলজট। রাস্তার পাশের দোকানগুলোর মধ্যে যে জুতো বিক্রেতারা প্লাস্টিকের চটি নিয়ে বসেন, তাঁদের তখন চাহিদা আকাশছোঁয়া। বর্ষার জল নালা দিয়ে সরার আগেই রাস্তাগুলি ছোট খালের রূপ নেয়। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় হাঁটা এক দুঃসাহসিক অভিযান হয়ে ওঠে।
বর্ষার সাথে নস্টালজিয়া
বর্ষা মানে শৈশবের স্মৃতি। টিনের ছাদে বৃষ্টির শব্দ, কাগজের নৌকা বানিয়ে পুকুরে ভাসানোর আনন্দ কিংবা ঘরের ভিতরে ঠাকুরদাদার গল্প শোনা। স্কুল ছুটি হলে রাস্তায় ছাতা না এনেও ভিজে যাওয়ার উচ্ছ্বাস যেন হারানো শৈশবের এক মিষ্টি অনুভূতি।
বাঙালির বর্ষাকালীন সাহিত্য ও সংগীত
বর্ষা বাঙালির মনের মধ্যে সৃষ্টিশীলতার এক আলাদা জগৎ খুলে দেয়। রবীন্দ্রনাথের "বৃষ্টির গান" থেকে নজরুলের "বর্ষার দোহাই"—সাহিত্য জুড়ে বর্ষা যেন এক চিরন্তন নায়ক।
একইভাবে, বর্ষাকালের গানও বাঙালির মনকে আন্দোলিত করে। “আমার এ পথ চাওয়াতে আনন্দ” কিংবা “বরষার প্রথম দিনের আলো” "মন মোর মেঘের সঙ্গী","শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা","এই মেঘলা দিনে একলা","আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে","বৃষ্টি তোমাকে দিলাম"—এগুলি শুধুই গান নয়, বাঙালির জীবনের অভিজ্ঞতা।
বর্ষার প্রতি প্রেম-ঘৃণার ব্যাখ্যা
বর্ষা যেমন বাঙালির রোমান্টিকতার আঁধারে আলো ছড়ায়, তেমনই দৈনন্দিন জীবনে এটি অনেক দুর্ভোগ ডেকে আনে। মনের মধ্যে যে এক ধরণের শান্তি এনে দেয়, তা আবার দৈনন্দিন ব্যস্ততায় বিঘ্ন ঘটায়।
বর্ষা নিয়ে বাঙালির এই দ্বৈত অনুভূতি প্রকৃতপক্ষে জীবনেরই প্রতিফলন। বৃষ্টির পর রোদ যেমন প্রকৃতিকে পরিপূর্ণ করে তোলে, তেমনই বাঙালির জীবনে বর্ষা মানে স্মৃতি, সৃষ্টিশীলতা এবং সংগ্রামের এক মেলবন্ধন।
উপসংহার
বর্ষা, বাঙালির জীবনে শুধুই এক ঋতু নয়। এটি এক অনুভূতি, এক জীবনযাপন। প্রেম আর ঘৃণার মিশ্রণে বাঙালির বর্ষা যেন সর্বদাই তাদের জীবনের চিত্রপটে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থেকে যায়।
No comments:
Post a Comment