কিন্তু তা সত্ত্বেও সে জীবন বিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, এস্কেপ করছে না... সে বাঁচতে চাইছে... সে বলছে বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, বাঁচার মধ্যেই আনন্দ
He wants to live
অপরাজিতই: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এক বহুমাত্রিক প্রতিভা:
বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মুকুটমণি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক আইকনই নন, বরং বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমর প্রতিমূর্তি। তাঁর গভীর, সংবেদনশীল অভিনয়শৈলী, সাহিত্যের প্রতি নিবিড় অনুরাগ এবং জনমানসে এক সহজাত ভদ্রলোকের প্রতিচ্ছবি আজও স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে অমলিন হয়ে আছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন যেন বাঙালি মননের একটি বিশাল ক্যানভাস, যেখানে তিনি একাধারে থিয়েটার, কবিতা, অভিনয় এবং সাংস্কৃতিক মনন নিয়ে অবিস্মরণীয় সব রঙের আঁচড় এঁকেছেন।
শৈশব ও শুরুর পথ:
১৯৩৫ সালে ১৯শে জানুয়ারি কলকাতার ময়মনসিংহ রোডে জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি অভিনেতা ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি এক গভীর প্রেম অনুভব করতেন। তবে, নাট্যমঞ্চে তাঁর প্রথম পদার্পণ তাঁকে অভিনয়ের জগতে নিয়ে আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন তিনি থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরবর্তীকালে বিশিষ্ট নাট্যকার শ্রীস্মরণীয় সিসির ভাদুড়ির নির্দেশনায় মঞ্চে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। এক অসামান্য ভদ্রপালক চরিত্রে তিনি শৈশব থেকেই নিজের শৈল্পিক অস্তিত্বের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটান।
সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্যে চলচ্চিত্রে পদার্পণ:
সত্যজিৎ রায়ের "অপুর সংসার" চলচ্চিত্রে অপু চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সৌমিত্র বাংলা চলচ্চিত্রে এমন এক স্থায়ী আসন গ্রহণ করেন, যা আজও অক্ষুণ্ণ। সত্যজিৎ রায় তাঁকে চলচ্চিত্রের জগতে নিয়ে আসেন এবং এই গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক বাঙালি চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অমর বন্ধন হয়ে রয়ে গেছে। একটি সাক্ষাত্কারে চ্যাটার্জী প্রকাশ করেছিলেন যে সত্যজিৎ অপু চরিত্রের জন্য প্রথমে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। “আমি সেই সময়ে থিয়েটার করছিলাম এবং সেলুলয়েডের কোনো স্বপ্ন ছিল না। আসলে ভারতীয় সিনেমা নিয়ে আমার রিজার্ভেশন ছিল। আমাদের কাছে থিয়েটার ছিল উচ্চ শিল্প আর সিনেমা ছিল ব্যাপক ব্যবহারের জন্য। থিয়েটারের তরুণ-তরুণীরা প্রায়ই এই ভুল ধারণায় ভোগেন এবং আমিও এর থেকে আলাদা ছিলাম না। কিন্তু যখন আমি পথের পাঁচালী দেখেছিলাম, তখন তা আমার মনকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছিল। আমি কল্পনাও করিনি যে সিনেমা সেই স্তরে উঠতে পারে এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম যে অভিনয় এবং চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত এভাবেই হবে।” তিনি এও জানান ওনাকে দেখেই সত্যজিৎ রায় ঠিক করেন যে তিনি অপুর সংসার বানাবেন। প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিততে অভিনয় করার জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যান সত্যজিৎ রায়ের কাছে কিন্তু সত্যজিৎ রায় ওনাকে বলেন দেখে "তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেলে অপু"। অপরাজিতা প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরে সত্যজিৎ রায় ফোন করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এবং এভাবেই প্রথম শুরু হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের একসঙ্গে পথচলা।১৪টি ছবিতে তাঁরা একসাথে কাজ করেন, যেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় প্রতিভা এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়। তাঁর চরিত্রগুলিতে বিশেষ করে “চারুলতা”র অমল, “ঘরে বাইরে”র সন্দীপ, এবং “দেবী”র উমাপ্রসাদ চরিত্রে সৌমিত্রর অভিনয়শৈলী শুধু দৃশ্যমান নয় বরং মনোগ্রাহী ছিল।এছাড়াও রয়েছে সোনার কেল্লা অভিযান দেবী প্রমুখ। ধীরে ধীরে তিনি গড়ে ওঠেন সত্যজিৎ রায়ের 'বরপুত্র'।
অপুর সংসারের সেই ফ্রেম এখন স্পষ্ট (শর্মিলা ঠাকুরের সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত):
কত টুকুই বা বয়েস ছিল ওনাদের। বালিকাবেলাই বলা যায়। দুরু দুরু বক্ষে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। 'অপু' বোধহয় মনের কথা আঁচ করে সে দিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কি? নার্ভাস লাগছে?" আমিও তেমনই। মাথা নেড়ে বলে দিয়েছিলন, "নার্ভাস? নাহ,একটুও নয়। "তার পরেই মানিকবাবু এমন ভাবে শট নিতে শুরু করেছিলেন যে বুঝতেই পারেননি ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছেন। 'স্টার্ট, সাউন্ড অ্যাকশন, দু'পা এগোও, সামনে তাকাও.... কাট!'
"কত দশক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অপুর সংসার-এর সেই ফ্রেম এখনও স্পষ্ট হয়ে আছে। সেই অপু,আমার পরম বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এমন তো নয় যে ঘনঘন দেখা হত। দেখাসাক্ষাৎ হত হয়তো খুবই কম। কিন্তু যখন হত, গল্পে ডুবে যেতে এক মুহূর্তও লাগত না। এক লহমায় ফিরে যেতাম সেই অপুর সংসারের দিনে। থাকত পারস্পরিক সম্মানবোধের পরিসর, যা কখনও লঘু হয়নি। দেখা হলে শুধুমাত্র সিনেমা তো নয়, বহু বিষয়ে মত বিনিময় করতাম আমরা। ঋদ্ধ হতাম তাঁর পাণ্ডিত্যের বহরে। এবং এটাও টের পেতাম যে আমার প্রতিও ওঁর ভালবাসা আর শ্রদ্ধার স্থান অটুট রয়েছে। জীবনের এই বহুরঙা চিত্রনাট্যে কখনও এতটুকু 'নার্ভাস' বা অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিনি ওঁর সঙ্গে।অরণ্যের সময় আমরা নানা রকম কাজ করেছি।
আউটডোরের কত না স্মৃতি আমার সৌমিত্রের সঙ্গে। ডাল্টনগঞ্জ আর বেতলার ছিপাদার ফরেস্ট-এ অরণ্যের দিনরাত্রির শ্যুটিং। তার বহু বছর পর ডুয়ার্সে গৌতম ঘোষের ছবি 'আবার অরণ্যে'। সেখানে মহুয়া খেয়ে সাঁওতালদের সঙ্গে তাঁদের নাচ নাচতাম আমরা। সৌমিত্র, শুভেন্দু এবং আমার একই গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ঘটনাচক্রে। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা আড্ডা মারত। চলত ওদের পান, গান এবং গভীর আড্ডা। সেই আড্ডার কথা আজ মনে করলে আফসোস হয় কেন যে রেকর্ড করে রাখিনি। কত যে মণিমাণিক্য ছিল সেই আলোচনায়। নাটক ছবি নিয়ে কী যে ভাল এবং গভীর আলোচনা। শিশির ভাদুড়ি থেকে গিরিশ ঘোষের নটি বিনোদিনী হয়ে সত্যজিৎ রায়ের কাজের খুঁটিনাটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ-কী না থাকতো সেখানে। তারই মধ্যে আমি কফি বানাতাম। কবিতা পড়ত সৌমিত্র, ওর উদাত্ত কণ্ঠে।"এভাবেই শর্মিলা ঠাকুরের কণ্ঠে আমরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা পাই।
কবিতা ও সাহিত্যে অবদান:
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধুমাত্র চলচ্চিত্রজগতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি একাধারে ছিলেন কবি, নাট্যকার এবং সাহিত্যপ্রীত ব্যক্তিত্ব। “একখন” নামে সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর সম্পাদনা দক্ষতার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলি সবসময় এক অন্তর্মুখী বেদনাকে ধারণ করতো যা পাঠকের মনের গভীরে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম। সাহিত্য ও নাটকের প্রতি তাঁর এই অঙ্গীকার তাঁকে বাংলার কাব্য ও নাট্যজগতে এক অন্যতম প্রতিভায় পরিণত করে। কবিতার প্রতিটি লাইনে এবং নাটকের প্রতিটি চরিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ সত্যিই অভিনব।বাংলা চলচ্চিত্র জগগতের এক প্রধান স্তম্ভ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভাকে বিভিন্ন ধারায় করেছিলেন। বাংলার চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যে এমন কোনও শিল্পী নেই, যাঁর একই সঙ্গে কবিতাসমগ্র, গদ্যসমগ্র এবং নাটকসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। আমার ধারণা, পুরো ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র অভিনেতাদের মধ্যেও কবিতাসমগ্র, গদ্যসমগ্র এবং নাটকসমগ্র আছে, এমন কারওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক বার, একটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়,জয় গোস্বামী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে একটা বোকার মতো প্রশ্ন করেন। কিন্তু প্রশ্নটি বোকার মতো হলেও যে-উচ্চতায় তাঁর উত্তরটিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই শিল্পী, তা ওনার কাছে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।ওনার প্রশ্নটি ছিল এই রকম: আপনি তো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে, সিনেমায় এবং নাটকে, দু'ভাবেই নিজের সত্তাকে প্রকাশ করতে পারেন। তা করেও চলেছেন অব্যাহত ভাবে। তা হলে আবার আপনার কবিতা লেখার দরকার হয় কেন? কবিতা তো মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার জন্যই লেখে। আপনি তো অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সেই প্রকাশ সম্ভব করতে পারছেন।উত্তরে বলেছিলেন, অভিনয়ের সময় কী হয় জানো, আমি কোনও একটা চরিত্রের অন্তরালে আত্মগোপন করি। বলা যায়, চরিত্রটিকে সামনে রেখে তার পিছনে লুকিয়ে পড়ি। বা, উবু হয়ে বসে থাকি। চরিত্রটিই তখন আমার আড়াল। এই বার সেই চরিত্রের সত্তার সঙ্গে নিজেকে অল্প অল্প করে মিশিয়ে চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার কাজটা শুরু হয় আমার মধ্যে। কিন্তু কবিতা লেখার চেষ্টা যখন করি তখন ব্যাপারটা হয়ে যায় একেবারে অন্য রকম। তখন কোনও চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে না আর। এই আমি, মানে আমার যা সারাংশ, তাকেই আমি সরাসরি কবিতায় বলতে পারছি। এই নিজের সারাংশকে বলার চেষ্টা আমার কলেজজীবন থেকেই সঙ্গে থেকে গেছে।
তাঁর হাঁটার ধরন বসল ফেলুদায়ে(সায়নী ঘটক এর সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত):
সত্যজিতের ২-স্ট্রেশন এবং পরবর্তী কালে বড় পর্দায় ফেলুদার যে ছবি বাঙালির মনে আঁকা হয়ে রয়েছে, তার রক্তমাংসের রূপটিই যেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফেলুদার যে কোনও একনিষ্ঠ পাঠকের মতোই সৌমিত্র নিজেও ফেলুর চরিত্রে তাঁর স্রষ্টার অদৃশ্য উপস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তবে স্রষ্টার 'ফেভারিট' বলে ফেলুদা নিয়ে সিনেমা হলে তিনিই প্রদোষচন্দ্র মিত্র হবেন, তা-ও যেন এক রকম অনিবার্য ছিল।
'তোপসে' সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় বললেন, "প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, 'সীমাবদ্ধ'র বরুণ চন্দ ফেলুদা হতে পারেন, চেহারার দিক থেকে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মাথায় প্রথম থেকেই সৌমিত্রকাকু ছিলেন। বলেওছিলেন ওঁকে, সবাই বলছে ছবিগুলো তোমার মতো করেই এঁকেছি, সুতরাং তোমাকেই ফেলু করতে হবে।" বাঙালির মননে, স্মৃতিতে, ফ্যান্টাসির দুনিয়া জুড়ে ফেলুদার যে জায়গা, সেটি আজও দখল করে রয়েছেন সৌমিত্র। ফেলুদার নিয়মানুবর্তিতা, শরীরচর্চা, বিবিধ বিষয়ে পড়াশোনার আগ্রহ ও অভ্যেস, তীব্র দেশাত্মবোধ, বন্ধুবাৎসল্য এবং রসবোধ- এর সব ক'টিই প্রাণ পেয়েছিল সৌমিত্রের অভিনয়ে। সেই সঙ্গে তাঁর হাতা-গোটানো পাঞ্জাবির উপরে চাদরটা জড়িয়ে নেওয়া কিংবা ডেনিম আর জ্যাকেটে অননুকরণীয় শৌখিনতা। "ওয়েস্টার্ন স্টাইলের সঙ্গে বাঙালিয়ানার মিশেলে ওই রকম আধুনিক ড্রেস ১৯৭৪ সালের একটা ছবিতে ভাবা হয়েছিল, যার সঙ্গে আজও রিলেট করতে পারে বাঙালি। সেই সঙ্গে ফেলুদার স্মার্ট হাঁটার স্টাইল, যেখানে সৌমিত্রকাকুর হাঁটার ধরনটাই ইম্পোজ করা হয়েছিল। 'সোনার কেল্লা'য় ৩৯ বছরের সৌমিত্রকাকুকে উইগ পরানো হয়েছিল ফেলুদার লুক সেট করতে। মাথায় অত চুল থাকতেও কেন উইগ, ১৪ বছরের আমি সেই প্রশ্ন করায় সৌমিত্রকাকু বলেছিলেন, 'আরও বেশি ভাল দেখতে ফেলুদা হয়ে যাব তা হলে'। 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এও সেই উইগটাই রাখা হল, কন্টিনিউইটি রাখতে। কিন্তু পরবর্তী কালে পর্দায় ফেলুদার ওই লুক আর ধরে রাখা হয়নি," বললেন সিদ্ধার্থ।ছবি হিসেবে সৌমিত্র 'সোনার কেল্লা'র চেয়ে এগিয়ে রাখতেন 'জয় বাধা ফেলুনাথাকে। তিন-চার বছর পরে দ্বিতীয় ছবিটা করার সময়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখাটাই একমাত্র চিন্তা ছিল তাঁর। এমনিতে মুকুল কিংবা রুকু, ছোটদের সঙ্গে সহজে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল ফেলুদার। কুশল চক্রবর্তীর কাছে তাঁর ফেলুদার 'ফার্স্ট ইম্প্রেশন'ই সেরা এখনও। "ডক্টর হাজরাকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার দৃশ্যটা শুট করে জয়পুর থেকে ট্রেনে করে জোধপুরে আসছিলাম সকলে। রাতের ট্রেন, মোমবাতি জ্বেলে ডিনার হচ্ছে। স্টেশনে দাঁড়াতেই এক ভিখিরি এসে খাবার চাইতে লাগল। সৌমিত্রকাকু হঠাৎ উঠে গিয়ে ওঁর নিজের খাবার প্যাকেটটা দিয়ে এলেন তাঁকে। বাকিরা হাঁ-হাঁ করে উঠতে উনি বলেছিলেন, 'আমি একটা রাত না খেলে কিছু হবে না আমার। কিন্তু ও আজ রাতে না খেলে মারা যেতে পারে।' ছ'বছর বয়সে অনেক কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু ওই ঘটনাটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল," স্মৃতিচারণ করলেন 'সোনার কেল্লা'র মুকুল।
সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং তারও পরে আবীর চট্টোপাধ্যায়- দুই শিল্পীই তাঁর জুতোয় পা গলিয়েছেন পরবর্তী কালে। তাঁদের কাছেও ফেলুদা মানে সৌমিত্র। সব্যসাচী যখন ফেলুদা করতে যাচ্ছেন, তখনও সৌমিত্র তাঁকে ফেলু সম্পর্কে নিজের বিশ্লেষণের খেই ধরিয়ে দিয়েছিলেন, "মনে রাখতে হবে, ফেলু একজন 'থিস্কিং ম্যান' অর্থাৎ চিন্তাশীল মানুষ।" সেই জন্যই চোখের অভিব্যক্তিতে মগজাস্ত্রে শান দেওয়ার ঝিলিক সৌমিত্রর ফেলুদাকে অমর করে রেখেছে। পায়চারির দৃশ্যে ক্লোজ শটে তার চঞ্চল ও বাক্সয় চোখ, সময় সময় তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠা চাহনি, কপালের উপর হাত রেখে মৃদু 'ড্রামিং'- এ সবই ফেলু মিত্তির হয়ে ওঠার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার। করেছিলেন সৌমিত্র। তিনি নিজে অবশ্য ফেলুর চরিত্রটা পেয়ে তৃপ্ত ছিলেন অন্য কারণে। সৌমিত্রর নিজের কথায়, "সোনার কেল্লা'র সময়ে আমার নিজের ছেলে-মেয়ে কিশোর- কিশোরী। তাই ফেলুর চরিত্র ছেলে- মেয়ের জন্যই করছি- এমন একটা ভাবনা আমাকে খুব খুশি করেছিল।"ফেলুদা বললেই নিজের ছোটবেলায় ফিরে যান আবীর চট্টোপাধ্যায়ও, "ফেলুদা আমাদের ছোটবলার হিরো। যার মতো হতে ইচ্ছে করে, যে কখনও ভুল করে না। পর্দায় ফেলুদা যে-ই হোন, বাঙালির ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই থাকবেন। আমার কাছেও তাই।
ভদ্রলোকের প্রতিচ্ছবি:
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবন ছিলো খুবই সাধারণ এবং বিনয়ী। শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও তারকাখ্যাতির মোহে আবদ্ধ হননি। তাঁর ব্যক্তিত্বে সবসময়ই এক অভিজাত ভদ্রলোকের সরলতা এবং নির্লোভতা পরিস্ফুট হয়েছে। প্রখ্যাত অভিনেতা হিসেবে এতোগুলো বছর কাটানোর পরেও তিনি একসাথে অনেক মানুষের সাথে মিশেছেন, তাঁদের উৎসাহ ও ভালোবাসায় ভরসা পেয়েছেন। অভিনেতা হিসেবে তাঁর কঠোর পরিশ্রম, মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং শিল্পের প্রতি ভক্তি তাঁকে আরো অনন্য করে তুলেছে।
ভাষ্যপাঠে সৌমিত্র:
তখনও তিনি করোনায় আক্রান্ত হননি, তার কিছু দিন আগেই একটি অভিনব কর্মকাণ্ডের শরিক হয়েছিলেন।সুকুমার রায়ের গোটা 'আবোল তাবোল' রেকর্ড করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৪ নভেম্বর ২০২০, শিশু দিবসে সেটি ইউটিউবে রিলিজ় করছে। সৌমিত্রর ভাষ্যপাঠের সঙ্গে অ্যানিমেশনও রয়েছে। পরিকল্পনায় শিলাদিত্য চৌধুরী। সৌমিত্রকে রেকর্ডিংয়ের সময়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁর পছন্দের বই সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন, 'আবোল তাবোল' আর 'গীতবিতান'-এর কথা। এ দিন ভাষ্যপাঠ রিলিজ় করেছেন সন্দীপ রায়।
উত্তরাধিকার: এক অমর অধ্যায়
এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৫ নভেম্বর,2020 এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ এবং সংস্কৃতির জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাঁর অবদান কেবলমাত্র বাংলাতেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অভিজাত প্রতীক হয়ে রয়েছেন। তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেননি, তাঁর অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে গেছেন। চলচ্চিত্র, থিয়েটার এবং সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরকাল বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে স্থান পাবে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই মহিমান্বিত জীবন যেনো বাংলার সংস্কৃতির এক অমলিন স্মৃতিসৌধ, যার প্রতিটি ইটের গাঁথুনি চিরকাল এক অন্তহীন মুগ্ধতায় আবদ্ধ থাকবে।
পুরো নিখুঁত করে লেখা
ReplyDeleteখুব সুন্দর একটা লেখা