Sunday, November 17, 2024

Bengali Art and Craft: The Heritage of Terracotta, Kantha Stitch, and Kalighat Paintings

বাংলার শিল্প ও কারুশিল্প: ঐতিহ্যের এক অনন্ত প্রবাহ

বাংলার শিল্প ও কারুশিল্প তার বহুমুখী সৌন্দর্য, ঐতিহ্য, এবং বাঙালির সৃষ্টিশীলতার নিখুঁত বহিঃপ্রকাশ। বাংলার মাটি, মানুষের আবেগ, ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে টেরাকোটা শিল্প, কাঁথা সেলাই, এবং কালীঘাট চিত্রকলার মতো অনন্য শৈল্পিক সৃষ্টি।

টেরাকোটা শিল্প: পোড়ামাটির অমর ইতিহাস

টেরাকোটা একটি লাতিন শব্দ: 'টেরা' অর্থ মাটি, আর 'কোটা' অর্থ পোড়ানো। মানুষের ব্যবহার্য পোড়ামাটির তৈরি সকল রকমের দ্রব্য টেরাকোটা নামে পরিচিত। আঠালো মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ প্রভৃতি মিশিয়ে কাদামাটি প্রস্তুত করা হয়। সেই মাটি থেকে মূর্তি, দৃশ্যাবলি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে টেরাকোটা ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। মানবসভ্যতার বিকাশকাল হতে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবীলনীয় সভ্যতা, মায়া সভ্যতায় এই শিল্পের প্রচলন ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য-এর বহু টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহর টেরাকোটা শিল্পের জন্য বিখ্যাত।

পাল যুগ (৮ম-১২শ শতাব্দী): এই সময় বৌদ্ধ মঠ এবং বিহারে টেরাকোটার প্রচলন দেখা যায়।পাল আমলে নির্মিত মন্দিরগুলি একটি স্বতন্ত্র বঙ্গ শৈলীকে চিত্রিত করেছে।বর্ধমান জেলার বরাকরের সিদ্ধেশ্বর মহাদেব মন্দির আদি পাল শৈলীর এমনই একটি চমৎকার উদাহরণ।টেরাকোটা ভাস্কর্য আলংকারিক উদ্দেশ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। চিত্রকলায়, দেয়ালচিত্রের জন্য ম্যুরাল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকর্মগুলিও এই সময়কালে যথেষ্ট উন্নতি দেখায়।

মল্লরাজ যুগ (১৬শ-১৮শ শতাব্দী): বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলিতে টেরাকোটার সর্বোচ্চ শৈল্পিক উৎকর্ষতা অর্জিত হয়।

মুঘল আমলের স্থাপত্য:  মুসলমান শাসন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে। এই সময়ে বাংলায় কাঠামো নির্মাণের মূল গঠনভঙ্গি ছিল ইসলামি রীতি অনুসারে। আর বাইরের কারুকার্য ও কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলার লৌকিকরীতির ছাপ দেখা যায়।

ইমারতে ইটের ব্যবহার বাংলার স্থাপত্যরীতির একটি বৈশিষ্ট্য। বাড়ি এবং বেশির ভাগ মন্দির ঢালু ধাঁচে তৈরি করা হতো। এর পিছনে যুক্তি ছিল বেশি বৃষ্টিতে জল দাঁড়াতে পারবে না। এই বিশেষ নির্মাণ পদ্ধতির নাম বাংলা। অঞ্চলের নামেই স্থাপত্যরীতির নাম হওয়ার এটা একটা উদাহরণ। পুরোনো অনেক মন্দিরের কাঠামো এই ধাঁচেই তৈরি হতো। এমনই দুটি কাঠামো পাশাপাশি জুড়ে দিলে তাকে জোড়-বাংলা বলা হতো।চাল বা চালাভিত্তিক মন্দির বানানোর রীতিও বাংলায় দেখা যায়। মন্দিরের মাথায় ক-টি চালা আছে, সে হিসাবেই কোনও মন্দির একচালা, কখনো দো-চালা, কখনো বা আট-চালা হতো। ইসলামীয় স্থাপত্যের ধাঁচে চালা গুলির মাথায়ও মাঝে মধ্যেই খিলান, গম্বুজ বানানো হতো। সাধারণ আয়তক্ষেত্রাকার কাঠামোর উপর একাধিক চূড়া দিয়ে তৈরি মন্দিরও এই সময় বাংলায় বানানো হয়। সেই গুলির নাম রত্ন। একটি চূড়া থাকলে সেটি একরত্ন মন্দির, পাঁচটি চূড়া থাকলে পঞ্চরত্ব মন্দির। এই মন্দিরগুলির বেশির ভাগের দেয়ালে পোড়ামাটির বা টেরাকোটার কাজ করা হতো। পোড়ামাটির তৈরি এই মন্দিরগুলি বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ছাড়াও বাংলার নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।

এই যুগের বাংলার স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসকে তিনটি মূল পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে (১২০১-১৩৩৯ খ্রিঃ) বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ত্রিবেণীতে জাফর খানের সমাধির ভগ্নাবশেষ, এবং বসিরহাট-এ ছড়িয়ে থাকা কিছু স্তূপ ছাড়া এসময়কার কোনও স্থাপত্যই আজ আর নেই।

দ্বিতীয় পর্যায়ের (১৩৩৯-১৪৪২ খ্রিঃ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য হলো মালদহের পান্ডুয়ায় সিকান্দর শাহের বানানো আদিনা মসজিদ। এ ছাড়া, হুগলি জেলায় ছোটো-পান্ডুয়ার মিনার ও মসজিদ এবং গৌড়ের শেখ আকি সিরাজের সমাধি এই পর্যায়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। তৃতীয় পর্যায়ে (১৪৪২-১৫৩৯ খ্রিঃ) বাংলায় ইন্দো-ইসলামি রীতির স্থাপত্য শিল্প সবচেয়ে উন্নত হয়। পাণ্ডুয়ায় সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহর (যদু) সমাধি (একলাখি সমাধি নামে বিখ্যাত) এই ধাঁসের সেরা নিদর্শন। উচ্চতায় খুব বেশি না হলেও, টেরাকোটার গম্বুজ ও তার অর্ধগোল আকৃতির জন্য এটি বাংলায় ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যের উন্নতির অন্যতম নজির। বরবক শাহের আমলে তৈরি গৌড়ের দাখিল দরওয়াজা এসময়ের আরও একটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। এছাড়াও সে সময়ের রাজধানী গৌড়ের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যের নজির হলো তাঁতিপাড়া মসজিদ, গুম্মাত মসজিদ ও লোটান মসজিদ। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হ্যয় ২৬ মিটার উচ্চতার ফিরোজ মিনার। ইট ও টেরাকোটার কাজ ছাড়া, এই মিনারটি সাদা ও নীল রং-এর চকচকে টালি দিয়েও অলংকৃত। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বড়ো সোনা মসজিদ গৌড়ের সবচেয়ে বড়ো মসজিদ।

              


উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:

1. বিষ্ণুপুর মন্দিরসমূহ (বাঁকুড়া):

রাসমঞ্চ মন্দির এবং মদনমোহন মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটা ফলকে মহাকাব্যের কাহিনি, গ্রামীণ জীবন, এবং দেবদেবীর চিত্রাঙ্কন, এনক্র্যাটনো(মল্ল রাজবংশের রাজা দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ সালে এই মাস্টারপিসটি তৈরি করেছিলেন। এই এনক্র্যাটনো মন্দিরে মদনা-মোহনা পূজা করা হয়। এ কারণে এটি মদনা-মোহনার মন্দির নামেও পরিচিত। এই  মন্দিরের উচ্চতা ৩৫ ফুট। মন্দিরের কাঠামোটি একটি বিশাল চূড়ার উপর অবস্থিত যা ল্যাটেরাইট মাটি দ্বারা গঠিত।)

বিশেষত্ব: খোদাই করা ফলকগুলোতে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম।

        



2. কৃষ্ণনগরের টেরাকোটা মূর্তি (নদিয়া):

মাটির পুতুল তৈরির এই কারুকাজটি ২০০- ২৫০ বছর পুরানো এবং এটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের ঘূর্ণি জেলার কৃষ্ণনগর নামক একটি স্থানে অনুশীলন করা হয় । পুতুল নির্মাতাদের মতে, এই কারুকাজটি যে এলাকায় অবস্থিত এবং চর্চা করা হয় সেটি মূলত ঘূর্ণিতে, যেহেতু সঠিক চিত্র নির্মাতারা এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। পুতুল তৈরির ঐতিহ্যবাহী ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করাই এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ।মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র (1710-1783), শিল্পের পৃষ্ঠপোষক, মাটির পুতুল তৈরিতে সমর্থন করেছিলেন। বাংলায় প্রথমবারের মতো কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করা একজন অগ্রগামী হিসেবে , তিনি স্থানীয় কারিগরদের উৎসাহিত করেন এবং বাংলার ঢাকা ও নাটোর জেলা থেকে আরও কুমোরদের নিয়ে আসেন কৃষ্ণনগরের পার্শ্ববর্তী ঘূর্ণিতে। তাই, মাটির প্রতিমা তৈরির বাঙালি ঐতিহ্যের সূচনা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে আজও সংস্কৃতির একটি পালিত বৈশিষ্ট্য। কৃষ্ণনগরের পুতুল তৈরির কারুশিল্প অনুশীলনকারী কারিগররা ' কুম্ভকারস' নামক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যারা কুমার এবং মাটির মডেল তৈরি করে। কৃষ্ণনগরে নারী ও শিশুসহ তিন শতাধিক মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শুরুতে চার-পাঁচটি পরিবার নিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন এটি একটি বড় সম্প্রদায়। একটি সম্প্রদায় হিসাবে, তারা খুব একীভূত হয় না. সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি সংস্কৃতির অবক্ষয় এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা হারানো এই শিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

নকশা:

কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলগুলো সাধারণত কর্মক্ষেত্রে সাধারণ বাঙালি নারী-পুরুষকে বন্দী করে। এই পুতুলগুলি কারিগরের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিভিন্ন আবেগ এবং বস্তুর বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা প্রদর্শন করে। যে কেউ এই পুতুলগুলি দেখে সহজেই দৃশ্যকল্পটি ব্যাখ্যা করতে পারে এবং অনুভব করতে পারে যে কারিগর চিত্রিত করতে চায়। উদাহরণ হিসেবে, আপনি দেখতে পারেন ঝুড়ি তাঁতিরা বাঁশের ছাল দিয়ে কাজ করছে; একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত শিব লিঙ্গের সামনে পূজা করছেন; ছাতা মেরামতকারী ভাঙা হাতল ঠিক করছেন; সাঁওতাল আদিবাসী পুরুষরা ঢোলের সাথে নাচছে; গ্রামীণ বাঙালি পুরুষ ও মহিলারা ঘরে জ্বালানি কাঠ নিয়ে যাচ্ছে; একজন লোহার ঢালাইকারী তার নৈপুণ্যে কাজ করছে; একজন মানুষ তুলো দিয়ে দড়ি তৈরি করছে; এবং মঞ্জিরা ও ঢোল নিয়ে পুরুষ ও মহিলা ভক্তরা কীর্তনে অংশগ্রহণ করে।

পুতুলগুলি গঙ্গা নদীর মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় (সম্প্রতি জাতীয় নদী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে), যাকে "ইটেল" বলা হয়, জোয়ার কমে গেলে অবশিষ্টাংশ। কৃষ্ণনগরের (নদিয়া জেলায়) মাটির পুতুলগুলি তাদের দৈনন্দিন গ্রামের জীবন- মাছ ধরা, কৃষিকাজ, ন্যাকড়া তোলা, ঝুড়ি তৈরি, রান্না করা, পরিষ্কার করা এবং পূজা করা ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত - এবং ফল, শাকসবজি, পাখি এবং প্রাণীর মতো বিষয়গুলি . তারা পাঁচ প্রজন্মেরও বেশি সময় ধরে দেশীয় কুমোরদের উত্তরাধিকারের অংশ।

চমত্কারভাবে কারুকাজ করা, এই মাটির পুতুল এবং বিভিন্ন আকারের মূর্তিগুলি তাদের চারপাশের জীবনের বাস্তব-জীবনের বর্ণনা দিয়ে সমর্থক এবং সাধারণ মানুষকে একইভাবে আনন্দিত করেছে। দেব-দেবীর মূর্তি, খড়ের ঘর ও তালগাছের বাংলার গ্রামীণ দৃশ্য, মুচি, পুরোহিত, ক্ষুদ্র এস্কিমো, পাখি, প্রাণী, ফল, শাকসবজি ইত্যাদির প্রতিলিপি সূক্ষ্মতা ও পরিপূর্ণ শৈল্পিকতার সঙ্গে করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলির বিশদ বিবরণ, বিশেষত তাদের পোশাক এবং আনুষাঙ্গিকগুলি সেই একক বা ডাবল প্লিট তৈরি করার জন্য সরঞ্জামগুলির দ্বারা আনা হয়, এখানে এবং সেখানে একটি ক্রিজ এবং কয়েকটি স্ট্রোকের মাধ্যমে, জীবন তাদের চোখে মিশে যায়।এই নৈপুণ্যের সাথে জড়িত মডেল তৈরি সম্পূর্ণরূপে কারিগরের হাতের দক্ষতার উপর নির্ভর করে । বিভিন্ন ধরণের মডেল রয়েছে - ভলিউমের উপর নির্ভর করে সেগুলিকে ছোট, মাঝারি এবং বড় হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে।

গুরুত্ব: এগুলি স্থানীয় মেলা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয়।


  



কাঁথা সেলাই: গ্রামীণ নারীদের সূক্ষ্ম শৈল্পিক দক্ষতা

ইতিহাস:

কাঁথার উৎপত্তি বাংলার গ্রামীণ এলাকায়। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি গৃহিণীরা পুরোনো কাপড় পুনর্ব্যবহার করে সূচিশিল্পের মাধ্যমে কাঁথা তৈরি করতেন।

কাঁথার উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এ।

ঊনবিংশ শতকে কাঁথার নকশা স্থানীয় মেলার গণ্ডি পেরিয়ে বাণিজ্যিক বাজারে পৌঁছায়।

উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:

1. নকশি কাঁথা (মুর্শিদাবাদ):

এই কাঁথায় ফুল, লতা-পাতা, এবং জীবনের গল্প সূচিকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয়।

বিশেষত্ব: প্রতিটি নকশি কাঁথা একটি জীবন্ত গল্প।

2. শাড়ি ও পোশাকে কাঁথা সেলাই (বীরভূম, নদিয়া):

শাড়ি, ওড়না, এবং পোশাকে কাঁথার নকশা আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে ব্যবহৃত হয়।

বিশ্বের পরিচিতি: ভারত এবং বিদেশের বাজারে এটি বাঙালির পরিচিতি বহন করছে।



কালীঘাট চিত্রকলা: বাংলার পটচিত্রের নতুন দিগন্ত

ইতিহাস:

কালীঘাট চিত্রকলার সঠিক উৎসটি শিল্প সমালোচক এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক এবং অনুমানের বিষয়, কারণ এমন কোনও ঐতিহাসিক বিবরণ নেই যা একটি নির্দিষ্ট তারিখ লিপিবদ্ধ করে বা এই ধরণের চিত্রকলার সূচনা চিহ্নিত করে, যা কালীঘাটে পটুয়াদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পেইন্টিংগুলিতে ব্যবহৃত কাগজের ধরন এবং রঙের মতো উপাদান প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে সেগুলি ১৯ শতকের প্রথমার্ধের অন্তর্গত।  বিভিন্ন ইউরোপীয় সংগ্রাহকদের দ্বারা এই চিত্রগুলি অধিগ্রহণের তারিখগুলি উল্লেখ করে, ঐতিহাসিকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে চিত্রগুলির আবির্ভাব মোটামুটিভাবে 19 শতকের প্রথম বা দ্বিতীয় চতুর্থাংশে কালীঘাটে বর্তমান কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সাথে মিলে যায়। ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট মিউজিয়াম ওয়েবসাইট উল্লেখ করে, উদাহরণস্বরূপ, জাদুঘরের শিল্পকর্মগুলি "১৮৩০ থেকে ১৯৩০ এর দশকের ১০০ বছরের মধ্যে তৈরি এবং সংগ্রহ করা হয়েছে"।  যাইহোক, এস. চক্রবর্তী অনুমান করেন "কালীঘাটের চিত্রকর্ম ১৮৫০-এর দশকের আগে প্রচলিত ছিল না"।কালীঘাট চিত্রকলার উত্থান উনিশ শতকের কলকাতায়, কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে। মূলত পটচিত্র থেকে উদ্ভূত, এই চিত্রকলার মধ্যে দেবদেবীর চিত্র, সামাজিক কাহিনি, এবং বিদ্রূপাত্মক বিষয়বস্তু স্থান পেয়েছে।

১৮০০-১৮৫০: প্রাথমিক পর্যায়ে দেব-দেবীর ছবি আঁকা হতো।

১৮৫০-১৯০০: সামাজিক বিদ্রূপ এবং ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা ফুটে ওঠে।


অঙ্কন পদ্ধতি: পটুয়ারা তাদের পরম্পরাগত জ্ঞান থেকে প্রকৃতি থেকেই নানা রঙ আহরণ করে।

১.হলুদ রঙ সংগৃহীত হয় হলুদ বা আলামাটি থেকে বা হলুদ গাছের শিকড় থেকে।

২.সবুজ রঙ সংগৃহীত হয় শিমপাতা বা হিঞ্চে শাকের রস থেকে। বেলপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করওে তৈরি হয় সবুজ রঙ।

৩.বেগুনি রঙ তৈরি হয় জাম বা পাকা পুঁই মুচুড়ি থেকে।

৪.নীল রং তৈরি হয় অপরাজিতা ফুল বা তুঁত থেকে।

৫.খড়িমাটির সঙ্গে সামান্য নীল মিশিয়ে তৈরি হয় সাদা রঙ।

৬.খয়েরি রঙ তৈরি হয় চুন বা আলামাটির সঙ্গে খয়েরের টুকরো মিশিয়ে।

৭.লালচে রঙ তৈরি হয় পোড়ামাটি বা লাল গিরিমাটি থেকে। পাকা তেলাকুচা থেকে পাওয়া যায় লাল রঙ। সজনে গাছের পাতা বেটে লাল রং তৈরি করা যায়।

৮.কালো রঙের জন্য পোড়ামাটির গা থেকে চেঁছে নেওয়া হয় ভুষোকালি। গাব গাছের শিকড় পুড়িয়েও তৈরি হয় কালো রঙ।



উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:

1. দেবদেবীর চালচিত্র:

 চালচিত্র হল সাবেকি দুর্গা প্রতিমার উপরিভাগে অঙ্কিত দেবদেবীর কাহিনিমূলক পটচিত্র, যা প্রধানত অর্ধগোলাকৃতি হয়।এটি দুর্গাচালা বা দেবীচাল নামেও পরিচিত। এই চিত্রকলার একটি নিজস্ব রূপরেখা ও শৈলীগত দৃঢ় বুনিয়াদ রয়েছে। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল ‘পট লেখা’, যা বাংলার পটচিত্রেরএকটি বিশেষ ধারা।চালচিত্রের মূল বিষয়বস্তু হল শিবদুর্গা, কৈলাস, শিব অনুচর নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার ইত্যাদি। বীরভূম জেলার হাটসেরান্দির সূত্রধর সমাজে এই ধরনের এক বিশেষ চিত্রসম্ভার দেখা যায়, যাকে দুর্গা পট বলা হয়। তবে এখানে দুর্গা প্রতিমার বদলে দুর্গা পটেই পূজার্চনা করা হয়। দুর্গা পটের উপর অর্ধবৃত্তাকার চালচিত্র থাকে। এই ধরনের চালচিত্রে রাম, সীতা, শিব, নন্দীভৃঙ্গী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শুম্ভ-নিশুম্ভ অঙ্কিত থাকে। কৃষ্ণনগররাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গার চালচিত্রের মধ্যে অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। এখানকার চালচিত্রে মাঝখানে থাকে পঞ্চানন শিব ও পাশে পার্বতী, তার একপাশে থাকে দশমহাবিদ্যা ও অন্য পাশে দশাবতার। ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা বলেছেন- "বাংলায় বিভিন্ন ধরনের চালচিত্রের প্রয়োগ আছে ও তাদের মধ্যে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মঠচৌরি চালির চালচিত্রে দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নিচে, একটির নিচে অপরটি। আবার সাবেক বাংলা চালিতে সেগুলো থাক থাক করে আলাদা আলাদা ভাবে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালিতে পটচিত্রগুলি থাকে পাশাপাশি।"

                              

2. সামাজিক বিদ্রূপাত্মক চিত্র:

সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল চর্চিত এই কালীঘাটের পট। শীতল মনোরম হস্ত কৌশলে অপূর্ব ছন্দ ভাবের প্রকাশ এই পট। প্রায় বৃত্তের ব্যাসের অভগ্ন ছাঁচে মোটা কালো রেখার নিখুঁত লম্বা টানে ফুটে উঠতো নারীর শান্ত ভাব বা উত্তেজক কামনীয় রূপ। পুরুষ দেহে গতিশীল শক্তি বা ভগ্নরূপ। কাঁধে শাল, বকলস আঁটা জুতো, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, বাবরি চুল, পটলচেরা চোখ, ধনুকাকৃতির ভ্রূ নিয়ে ‘বাবু পট’ হলো মূল আকর্ষণ। এ পটে থাকে সৌখিন চেয়ার, হুঁকো, তন্বি মেয়ে, নাটকের মঞ্চ-সহ অনুসঙ্গিক নানা ধরনের বা চরিত্রের খণ্ড দৃশ্য। মূর্তির রেখাগুলির গভীরতা ফুটিয়ে তোলার জন্য মূর্তির পেছনে অন্ধকার পরিবেশ তৈরি করা হতো,যেন রাতের অন্ধকার। আর আলোর মধ্যে অন্তরঙ্গ লাবণ্য ও বাবু সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা বা যৌনতা। রানির মুকুট যেমন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, তেমনি ইঁদুরের মাথায় বিবির পা বা সাপের মাথায় ব্যাঙের নাচন দৃশ্য বেশ হাসির উদ্রেক করে। নানা চরিত্র কালীঘাট পটের বিষয় হয়েছে। মন্দির দর্শনে আসা ভক্তদের জন্য তৈরি হয়েছে হিন্দু দেবদেবী ও পৌরাণিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কিছু পট। যেমন রাসলীলা, কৃষ্ণলীলা, শিব-পার্বতী, কালী, নরসিংহ অবতার, কাকের পিঠে কৌমারী। পটের বিষয় হিসাবে ধর্মকথার বাইরে ঐতিহাসিক বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন লক্ষ্মীবাঈ, শ্যামাকান্তের বীরত্ব, শের খাঁ ও বাঘের লড়াইসহ নানা ঘটনা। সামাজিক বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে সাহেব পাড়া ও দেশি পাড়ার নানা ছবি। যেমন সতীর দেহত্যাগ, মাছকাটা, বর-কনে, স্ত্রৈণ স্বামী, মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার, বাবু-ভণ্ডদের বেলাল্লাপনা, বিবি সুন্দরী, সাহেব, গোরা সৈন্য। নানা চরিত্র নিয়ে নানা ব্যঙ্গ দৃশ্য তুলে ধরে সমাজ সচেতনতার চেষ্টা। আর শিশুদের নজরে পড়ার জন্য তৈরি হয়েছে পশু-পাখির নানা ছবি। ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে সাপের ব্যাং শিকার, বিড়ালের মাছ বা পাখি শিকার কিংবা লব-কুশের হাতে বন্দি হনুমান। তৈরি হয়েছে শিয়াল রাজার গল্প-চিত্র। অর্থাৎ নানা বিষয়।

উদাহরণ: ব্রিটিশ আমলের "বাবু কালচার" বা স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের বিদ্রূপ।


         


3. আধুনিক কালীঘাট পেইন্টিং:

আধুনিক শিল্পীরা এই ধারা পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আজকাল পেইন্টিং, গৃহসজ্জার সামগ্রী এবং ব্যাগে এই নকশা ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলার কারুশিল্পের বৈশিষ্ট্য ও ভবিষ্যৎ

বাংলার এই তিনটি শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি শিল্পকর্ম বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

1. টেরাকোটা শিল্পের জন্য:

অযোধ্যার রামমন্দিরের প্রবেশপথে বসানো হয়েছে রামায়ণে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার ২০০টি ম্যুরাল। যেগুলি তৈরি হচ্ছে পাথর, সিমেন্ট, সেরামিক টাইল, ফাইবার ও পোড়ামাটি দিয়ে। এর মধ্যে ১০০টি ম্যুরাল টেরাকোটার তৈরি। সেই কাজটিই করেছেন কৃষ্ণনগরের শিল্পী বিশ্বজিৎ। কাজের তদারকি করার জন্যই গত কয়েক মাস ধরে তাঁকে অযোধ্যা আর কৃষ্ণনগরের মধ্যে ছুটে বেড়াতে হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে মাটির কাজ থেকে পোড়ানোর কাজ পর্যন্ত হচ্ছে কৃষ্ণনগরের বেলেডাঙায় বিশ্বজিতের স্টুডিয়োয়। তার পরে সেগুলি টুকরো আকারে চলে যায় অযোধ্যায়। সেখানে রামমন্দিরের প্রবেশপথ, যার নাম দেওয়া হয়েছে ধর্মপথ, তার দু’ধারে বসানো হয়েছে এই কাজ। এই কাজে বিশ্বজিৎকে সাহায্য করছেন ২৭ জন সহযোগী শিল্পী।স্থানীয় কারিগরদের অর্থনৈতিক সহায়তা।আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে তাদের কাজ তুলে ধরা।

2. কাঁথা সেলাইয়ের জন্য:

কাঁথা সেলাই শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে এর আরও ব্যবহার।

3. কালীঘাট চিত্রকলার জন্য:

আধুনিক শিল্পকলার সঙ্গে এই ধারার সংমিশ্রণ।

ক্যালেন্ডার, গৃহসজ্জার পণ্য এবং পোশাকে কালীঘাট নকশার প্রয়োগ।

উপসংহার

বাংলার টেরাকোটা, কাঁথা, এবং কালীঘাট চিত্রকলা শুধু শৈল্পিক দক্ষতার নিদর্শন নয়; এগুলি বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মানুষের জীবনের গভীরতম গল্প বলে। এই শিল্পগুলিকে সংরক্ষণ ও প্রসারিত করা আমাদের দায়িত্ব, যাতে আগামী প্রজন্মও বাংলার এই গৌরবময় ঐতিহ্য জানতে পারে।





No comments:

Post a Comment

Psychological Flow While Reading Books: Exploring the Reader's Journey Through Bengali And English Classics and Poetry

  বই পড়ার সময় মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ: বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব এবং পাঠকদের মানসিক জগৎ ভূমিকা: বই পড়া মানেই কেবল গল্প বা জ্ঞান আহরণ ন...