"রাজত্ব একলা যদি রাজারই হয় প্রজার না হয় তাহলে সেই খোঁড়া রাজত্বের লাফানি দেখে তোরা চমকে উঠতে পারিস কিন্তু দেবতার চোখে জল আসে"
--- 'মুক্তধারা' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দ্রোহ কার্নিভাল ২০২৪: প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা
২০২৪ সালের দুর্গা পুজোতে যখন কলকাতা সেজেছিল উৎসবের আলোয়, তখনই শহরের বুকে ঘটে গেল এক নজিরবিহীন আন্দোলন—দ্রোহ কার্নিভাল। এটি ছিল রাজ্যের জুনিয়র চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের (Joint Platform of Doctors) আয়োজিত প্রতিবাদ, যা আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনটি রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের নীরবতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের একটি প্রতীকী কর্মসূচি হিসেবে পালন করা হয়।
প্রতিবাদের পটভূমি:
দ্রোহ কার্নিভালের মূল কারণ ছিল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এক জুনিয়র চিকিৎসককে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়, যা পুরো চিকিৎসক মহলে শোকের ছায়া ফেলে। এই ঘটনার পর রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসকরা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের দিক থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায়, প্রতিবাদের নতুন রূপ হিসাবে দ্রোহ কার্নিভাল আয়োজন করা হয়।
দ্রোহ কার্নিভালের উদ্দেশ্য:
এই কার্নিভালের মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় স্তরে কলকাতার এই চিকিৎসক আন্দোলনকে তুলে ধরা। দুর্গা পুজোর সময়, যখন আন্তর্জাতিক পর্যটক এবং অতিথিরা শহরে উপস্থিত থাকেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকরা তাদের দাবি এবং আরজি করের ঘটনা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার যখন দুর্গা পুজোর উৎসবমুখর কার্নিভালের আয়োজন করছিল, ঠিক তখনই ডাক্তাররা তাদের দ্রোহের বার্তা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
দ্রোহ কার্নিভালের ১৮টি দাবি:
1. আরজি করের ঘটনায় দ্রুত বিচার এবং দোষীদের শাস্তি।
2. চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
3. সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে সিসিটিভি এবং অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি।
4. সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
5. চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা।
6. জুনিয়র ডাক্তারদের কাজের চাপ কমানো।
7. সরকারি হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা।
8. সব হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা।
9. কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও অন্যান্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ।
10. চিকিৎসকদের জন্য বীমা এবং অন্যান্য আর্থিক সুরক্ষা।
11. জরুরি বিভাগে ডাক্তারদের সুরক্ষা বৃদ্ধির ব্যবস্থা।
12. নতুন ডাক্তারদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং উন্নত শিক্ষার সুযোগ।
13. চিকিৎসকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি।
14. সিনিয়র এবং জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে কাজের পরিবেশের উন্নতি।
15. প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র এবং সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ।
16. রোগীদের জন্য অপেক্ষার সময় কমানো এবং জরুরি পরিষেবার উন্নতি।
17. প্রশাসনিক পদক্ষেপের স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।
18. সমস্ত চিকিৎসকদের জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা।
এই দাবিগুলির মাধ্যমে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের নিরাপত্তা এবং পেশাগত সম্মানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের কাছে তাদের দাবিগুলি তুলে ধরেন.
দ্রোহ কার্নিভালের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব:
কলকাতা কবে দেখেছে এমন 'দ্রোহের কার্নিভাল'? মঙ্গলবার হুইলচেয়ারে ধর্মতলায় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে হাজির হয়ে এক বৃদ্ধা বললেন, "দম্ভের কার্নিভালের পাল্টা মানুষের এই কার্নিভাল ইতিহাস তৈরি করেছে।” বললেন, "৯ অগস্ট আর জি কর এ আমাদের দুর্গা বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। প্রতিমা ছাড়াই তাই আমাদের অধিকার রক্ষার কার্নিভাল চলছে।” কথা শেষ হল না বৃদ্ধার। ভিড়ের মধ্যে থেকে স্লোগান উঠল, “দুর্গা যাচ্ছে ওই, বিচার হচ্ছে কই?”.
রানী রাসমণি মোরে, ইডেন গার্ডেন্সের দিকে যেখানে পুলিশ গার্ডেল বসিয়ে রেখেছিল তার সামনের দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একের পর এক দুর্গা প্রতিমা।রেড রোডের সরকারি কার্নিভাল হয়ে এই পথে নেতাজী মূর্তি প্রদক্ষিণ করে বিসর্জনের জন্য যাচ্ছে । প্রতিটি গাড়ি নেতাজীর মূর্তি প্রদক্ষিণ করছে আর প্রতিমার মুখ ঘুরছে আন্দোলনকারীদের দ্রোহের কার্নিভালের দিকে হাজার হাজার মানুষের কালো মাথা পার করে এক জায়গা থেকে উজ্জ্বল দুর্গা মূর্তির মুখ ঘুরছে ভিড়ের দিকে আর স্লোগান "We Want Justice"
দ্রোহ কার্নিভাল রাজ্যের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। চিকিৎসকরা দাবী করেন, রাজ্য সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই, পুজোর কার্নিভালের দিনটি বেছে নিয়ে এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তাদের নীরবতার প্রতিবাদ করলেন।
লৌহপ্রাকার ও জনজোয়ার:
কলকাতা পুলিশের কমিশনারের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয় দ্রোহের কার্নিভাল যেখানে হওয়ার কথা সেই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ সহ ময়দানের সর্বত্র ১৬৩ ধারা জারি করা হচ্ছে অর্থাৎ পাঁচ জন বা তার বেশি লোকের জমায়েত এই জায়গায় নিষিদ্ধ এই পরিস্থিতিতে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ এবং সেই সংলগ্ন ডোরিনা ক্রসিংয়ে গিয়ে দেখা যায়,গার্ডরেল দিয়ে সমস্ত রাস্তা ঘিরে দিচ্ছে পুলিশ। প্রায় সাত ফুট লম্বা লোহার ব্যারিকের বসে তাদের লোহার চেন ঝুলিয়ে তালা ঝোলানো হয়েছিল সামনে পাহারায় ছিল কয়েকশ পুলিশকর্মী।দুপুর ৩ তে খবর আসে আদালত ১৬৩ ধারা প্রত্যাহার করেছে এবং এই নির্দেশে রাস্তায় নামে আন্দোলনকারীরা। রানী রাসমণি এভিনিউ এর কাছে এসে কেউ কেউ ধরেন প্রতিবাদের গান, অনেকেই বাজাতে দেখা যায় ঢাক ঢোল,হাতে প্ল্যাকার্ড ।সন্ধ্যার মুখে শুরু হয় এলাকা জুড়ে মানববন্ধন। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দু'পাশে সেই মানববন্ধনের মধ্যে দিয়ে পার করানো হয় সরকারি কার্নিভালের প্রতিমাবাহী গাড়ি। সেই গাড়ি দেখে জনতা ধ্বনি দেয়, 'শেম, শেম'। কার্নিভালে আসা একটি পুজো কমিটির গাড়ি এই ভিড়ের সামনে পড়ে। সেই গাড়ি ধরেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। সেখানে উপস্থিত ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ও বিক্ষোভের মুখে পড়েন। ইন্দিরা যদিও বলেন, "আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি বজায় রাখা পুলিশের কাজ। পুলিশ সেই চেষ্টাই করছে।" অনশন মঞ্চের সামনেও সেইসময় ভিড়ের চাপে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভিড়ের মধ্যেই দেখা যায় অপর্ণা সেন, চৈতি ঘোষালদের। বিকেল থেকেই অবশ্য অনশন মঞ্চের সামনে ভিড় বাড়ছিল। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, ধর্মতলার অনশনমঞ্চ, ধর্মতলা মোড় ছাপিয়ে ক্রোধ, প্রতিবাদ আর চোখের জলের যে ভিড় ঢেউয়ের মতো মিলেমিশে জোয়ার তৈরি করেছিল গোধূলি থেকেই, প্রাক- কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ যার সাক্ষী।
অনশনরত ডাক্তাররা:
ডাক্তারদের এই অনশন চলছে,সাধারণ জনগণ ওনাদের পাশে আছে।যথা সাধ্য চেষ্টা সবাই করে যাচ্ছেন। সমস্ত ডাক্তারদের জানাই কুর্নিশ।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতা:
দ্রোহ কার্নিভাল ২০২৪ শুধু একটি দিনের ঘটনা ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের প্রতীক। এই আন্দোলন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একটি জাগরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই আন্দোলনটি কেবল আরজি করের ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রাজ্যের চিকিৎসক সমাজের নানা সমস্যার প্রতিফলন ঘটায়।
উপসংহার:
২০২৪ সালের পুজো কার্নিভাল শুধু আনন্দ এবং উৎসবের ছিল না, তা এক দ্রোহের বার্তাও বয়ে এনেছিল। দ্রোহ কার্নিভাল চিকিৎসকদের জন্য একটি নতুন মঞ্চ তৈরি করেছে যেখানে তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং সঠিক কর্ম পরিবেশের দাবিতে একত্রিত হতে পেরেছে।প্রকৃতপক্ষে দ্রোহ কার্নিভালের সামনে সব কার্নিভাল ফিকে হয়ে গেছে।প্রকৃতই - "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"
We want justice
ReplyDelete