দুর্গা পূজা হল উল্লাস, রঙ এবং আবেগের এক দুর্দান্ত উদযাপন, এবং আমার কাছে তৃতীয়া এই স্মৃতিগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি স্থান দখল করে। কলেজের হোস্টেল জীবনে, তৃতীয়ার সকালে আমরা সবাই মিলে ঠিক সকাল ৫টায় প্যান্ডেল দেখতে বেরিয়ে যাই —এটি ছিল আমাদের জীবনের একটি অমূল্য অভিজ্ঞতা।
১. ভোরে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা:
আমরা হোস্টেলে থাকি। রাত্রিবেলা আটটার পরে আমাদের হোস্টেল থেকে বেরোনো নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ার দিন রাত্রিবেলা আমার দাদা আমায় ফোন করে জানায় যে দাদা ও দাদার বন্ধুরা কলকাতায় ঠাকুর দেখতে আসছে। সারা রাত ধরে কলকাতায় ঠাকুর দেখার যে বিষয়টা সেটা শুধুমাত্র যারা দেখেছে তারাই বুঝতে পারবে। এই কথাটা শুনে আমার রুমমেট এর মাথায় আসে এক বুদ্ধি। সে বলে ওঠে -"আমরা রাত্রে ঠাকুর দেখতে পারব না তো কি হয়েছে? ভোরে তো ঠাকুর দেখতে পারি"
যেমন কথা তেমন কাজ। তখন আমরা হোস্টেলে আরো কিছু জন বন্ধু মিলে ঠিক করি যে আমরা ভোর সাড়ে চারটের সময় হোস্টেল থেকে বেরোবো এই বলে যে আমরা মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি। সেই অনুযায়ী আমরা নিজেরা নিজেদের মতো একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলি যে আমরা সেদিন সকাল বেলাতে কোন কোন প্যান্ডেল গুলো দেখব। আমাদের মিশন হল ভোরের ঠাকুর দেখা।
২. হোস্টেল থেকে বেরোনো:
গত রাতের কথা অনুযায়ী সকলেই ভোর সাড়ে চারটের(৪.৩০) মধ্যে তৈরি।কিন্তু প্রশ্নটা হলো যে আমাদের হোস্টেলের ওয়াডেন কে দিয়ে কি করে দরজা খোলা যায়। তখন ভোর সাড়ে চারটে চারিদিকে অন্ধকার। এত তাড়াতাড়ি ওয়াডেন কোনভাবেই দরজা খুলবে না সেটা আমাদের জানা ছিল। তাই ঠিক যখন কাটায় কাটায় পাঁচটা বাজে আমি ফোন করলাম ওয়াডেনকে। বললাম যে আমরা মর্নিং ওকে যাব তাই দরজা খুলে দিতে।
ওয়াডেন আমাদের দেখে কিছুটা সন্দেহ করেছিল কারণ আমরা ছুটির দিনে সকাল পাঁচটায় উঠে মর্নিংওয়াকে যাওয়ার মত লোক নয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা বেরিয়ে যাই ঠাকুর দেখতে।
সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া দুর্গা পূজার উন্মাদনা ভোরের কোলাহলে পুরো শহরকে ঘিরে ফেলে। সেই সময়, যখন শহরটি ঘুমাচ্ছিল, আমরা হাসি এবং উন্মাদনার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটু হাঁটার—কিন্তু বাস্তবে তা ছিল প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেলে যাওয়ার এক পরিকল্পনা।
৩.ভোরের বর্ণনা:
পুজোর সময় ভোর একটু অন্যরকমই হয়। আমরা যখন বেরোলাম তখন রাস্তায় কোন লোক ছিল না। তাছাড়া আমরা যেখানে থাকি সেখানে হয়তো একটু লোক কমই কিন্তু সত্যি রাস্তায় লোক কম ছিল। ধীরে ধীরে চারিদিকে আলো ফুটছে ,পাখিদের কিচির মিছির ,সকালের শান্ত স্নিগ্ধ কোমল হাওয়া সবমিলিয়ে যেন এক আলাদাই অনুভূতি সৃষ্টি করছিল। একটু দূরে যাওয়ার পরেই আমরা শুনতে পাই -"জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিনী"। সঙ্গে সঙ্গে দেহে এক শিহরণ সৃষ্টি
৪. প্যান্ডেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা:
আমরা যেহেতু সাউথ কলকাতায় থাকি তাই আমাদের পরিকল্পনা ছিল সাউথের প্যান্ডেল গুলো ভোর ভোর ঘুরে নেওয়া।প্রথম আমরা যে প্যান্ডেলটি দেখেছিলাম সেটা হচ্ছে চেতলা অগ্রগনি ক্লাব। বারাণসীর ঘাটের আদলে বানানো হয়েছিল এই অপূর্ব মন্ডপটি। সেখান থেকে দশ মিনিট হাঁটা পথে আমরা চলে যাই আলিপুর সার্বজনীনে। সেখানে মন্ডপে তুলে ধরা হয়েছিল বহুরূপীদের জীবনযাত্রাকে। এক কথায় অসাধারণ ছিল সে মণ্ডপ। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে খাই এক কাপ চা। সেখানে দেখা হয় আমার দাদার সাথে। তারপর আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে যায় সুরুচি সংঘের ঠাকুর দেখতে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সুরুচি সংঘের মন্ডপ তখনো পর্যন্ত উদ্বোধন হয়নি। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা চলে আসি ত্রিধারা মন্ডপে। ত্রিধারা, বালিগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব, একডালিয়া, হিন্দুস্তান ক্লাব, হিন্দুস্তান পার্ক তিন থেকে চারটে নাম না জানা মণ্ডপ দেখে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দি।
৫.আমার অভিজ্ঞতা:
তৃতীয়ার এই ভোরের অভিজ্ঞতা শুধু একটি বিশেষ দিনই ছিল না, বরং আমাদের বন্ধুত্বের একটি অমূল্য স্মৃতি। সব বন্ধুরা মিলে সকালবেলাতে হইহই করতে করতে মন্ডপ দেখতে যাওয়া,মজা সব মিলিয়ে কলেজ জীবনের এই সব মুহূর্ত আমার হৃদয়ের পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে।
এভাবে তৃতীয়া আমাদের সবার জন্য এক বিশেষ দিন হয়ে ওঠে, যেখানে আমরা বন্ধুত্ব, আনন্দ এবং দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে নতুন করে একসঙ্গে হয়ে উঠেছিলাম। দুর্গা পূজার এই উপলক্ষে ভোরবেলার স্নিগ্ধতা এবং বন্ধুত্বের স্মৃতি কখনো ভুলবো না।
লিখেছিস খুব ভালো❤️
ReplyDeleteKhub sundor ❤️
ReplyDelete