Wednesday, October 16, 2024

Dhroho Carnival 2024: A Protest Against Injustice in Kolkata

"রাজত্ব একলা যদি রাজারই হয় প্রজার না হয় তাহলে সেই খোঁড়া রাজত্বের লাফানি দেখে তোরা চমকে উঠতে পারিস কিন্তু দেবতার চোখে জল আসে"

               --- 'মুক্তধারা' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্রোহ কার্নিভাল ২০২৪: প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা

২০২৪ সালের দুর্গা পুজোতে যখন কলকাতা সেজেছিল উৎসবের আলোয়, তখনই শহরের বুকে ঘটে গেল এক নজিরবিহীন আন্দোলন—দ্রোহ কার্নিভাল। এটি ছিল রাজ্যের জুনিয়র চিকিৎসকদের যৌথ মঞ্চের (Joint Platform of Doctors) আয়োজিত প্রতিবাদ, যা আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনটি রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের নীরবতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের একটি প্রতীকী কর্মসূচি হিসেবে পালন করা হয়।

প্রতিবাদের পটভূমি:

দ্রোহ কার্নিভালের মূল কারণ ছিল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনা। এক জুনিয়র চিকিৎসককে কর্মরত অবস্থায় ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়, যা পুরো চিকিৎসক মহলে শোকের ছায়া ফেলে। এই ঘটনার পর রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসকরা ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ করে আসছিলেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের দিক থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায়, প্রতিবাদের নতুন রূপ হিসাবে দ্রোহ কার্নিভাল আয়োজন করা হয়।

দ্রোহ কার্নিভালের উদ্দেশ্য:

এই কার্নিভালের মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় স্তরে কলকাতার এই চিকিৎসক আন্দোলনকে তুলে ধরা। দুর্গা পুজোর সময়, যখন আন্তর্জাতিক পর্যটক এবং অতিথিরা শহরে উপস্থিত থাকেন, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকরা তাদের দাবি এবং আরজি করের ঘটনা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার যখন দুর্গা পুজোর উৎসবমুখর কার্নিভালের আয়োজন করছিল, ঠিক তখনই ডাক্তাররা তাদের দ্রোহের বার্তা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।


দ্রোহ কার্নিভালের ১৮টি দাবি:

1. আরজি করের ঘটনায় দ্রুত বিচার এবং দোষীদের শাস্তি।

2. চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

3. সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে সিসিটিভি এবং অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি।

4. সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।

5. চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা।

6. জুনিয়র ডাক্তারদের কাজের চাপ কমানো।

7. সরকারি হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা।

8. সব হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা।

9. কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও অন্যান্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ।

10. চিকিৎসকদের জন্য বীমা এবং অন্যান্য আর্থিক সুরক্ষা।

11. জরুরি বিভাগে ডাক্তারদের সুরক্ষা বৃদ্ধির ব্যবস্থা।

12. নতুন ডাক্তারদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং উন্নত শিক্ষার সুযোগ।

13. চিকিৎসকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি।

14. সিনিয়র এবং জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে কাজের পরিবেশের উন্নতি।

15. প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র এবং সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ।

16. রোগীদের জন্য অপেক্ষার সময় কমানো এবং জরুরি পরিষেবার উন্নতি।

17. প্রশাসনিক পদক্ষেপের স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।

18. সমস্ত চিকিৎসকদের জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করা।

এই দাবিগুলির মাধ্যমে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের নিরাপত্তা এবং পেশাগত সম্মানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং রাজ্য সরকার ও প্রশাসনের কাছে তাদের দাবিগুলি তুলে ধরেন.

দ্রোহ কার্নিভালের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব:

কলকাতা কবে দেখেছে এমন 'দ্রোহের কার্নিভাল'? মঙ্গলবার হুইলচেয়ারে ধর্মতলায় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে হাজির হয়ে এক বৃদ্ধা বললেন, "দম্ভের কার্নিভালের পাল্টা মানুষের এই কার্নিভাল ইতিহাস তৈরি করেছে।” বললেন, "৯ অগস্ট আর জি কর এ আমাদের দুর্গা বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। প্রতিমা ছাড়াই তাই আমাদের অধিকার রক্ষার কার্নিভাল চলছে।” কথা শেষ হল না বৃদ্ধার। ভিড়ের মধ্যে থেকে স্লোগান উঠল, “দুর্গা যাচ্ছে ওই, বিচার হচ্ছে কই?”.

রানী রাসমণি মোরে, ইডেন গার্ডেন্সের দিকে যেখানে পুলিশ গার্ডেল বসিয়ে রেখেছিল তার সামনের দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একের পর এক দুর্গা প্রতিমা।রেড রোডের সরকারি কার্নিভাল হয়ে এই পথে নেতাজী মূর্তি প্রদক্ষিণ করে বিসর্জনের জন্য যাচ্ছে । প্রতিটি গাড়ি নেতাজীর মূর্তি প্রদক্ষিণ করছে আর প্রতিমার মুখ ঘুরছে আন্দোলনকারীদের দ্রোহের কার্নিভালের দিকে হাজার হাজার মানুষের কালো মাথা পার করে এক জায়গা থেকে উজ্জ্বল দুর্গা মূর্তির মুখ ঘুরছে ভিড়ের দিকে আর স্লোগান "We Want Justice"

দ্রোহ কার্নিভাল রাজ্যের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। চিকিৎসকরা দাবী করেন, রাজ্য সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই, পুজোর কার্নিভালের দিনটি বেছে নিয়ে এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা তাদের নীরবতার প্রতিবাদ করলেন।



                                                             

লৌহপ্রাকার ও জনজোয়ার:

কলকাতা পুলিশের কমিশনারের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয় দ্রোহের কার্নিভাল যেখানে হওয়ার কথা সেই রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ সহ ময়দানের সর্বত্র ১৬৩ ধারা জারি করা হচ্ছে অর্থাৎ পাঁচ জন বা তার বেশি লোকের জমায়েত এই জায়গায় নিষিদ্ধ এই পরিস্থিতিতে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ এবং সেই সংলগ্ন ডোরিনা ক্রসিংয়ে গিয়ে দেখা যায়,গার্ডরেল দিয়ে সমস্ত রাস্তা ঘিরে দিচ্ছে পুলিশ। প্রায় সাত ফুট লম্বা লোহার ব্যারিকের বসে তাদের লোহার চেন ঝুলিয়ে তালা ঝোলানো হয়েছিল সামনে পাহারায় ছিল কয়েকশ পুলিশকর্মী।দুপুর ৩ তে খবর আসে আদালত ১৬৩ ধারা প্রত্যাহার করেছে এবং এই নির্দেশে রাস্তায় নামে আন্দোলনকারীরা। রানী রাসমণি এভিনিউ এর কাছে এসে কেউ কেউ ধরেন প্রতিবাদের গান, অনেকেই বাজাতে দেখা যায় ঢাক ঢোল,হাতে প্ল্যাকার্ড ।সন্ধ্যার মুখে শুরু হয় এলাকা জুড়ে মানববন্ধন। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দু'পাশে সেই মানববন্ধনের মধ্যে দিয়ে পার করানো হয় সরকারি কার্নিভালের প্রতিমাবাহী গাড়ি। সেই গাড়ি দেখে জনতা ধ্বনি দেয়, 'শেম, শেম'। কার্নিভালে আসা একটি পুজো কমিটির গাড়ি এই ভিড়ের সামনে পড়ে। সেই গাড়ি ধরেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। সেখানে উপস্থিত ডিসি সেন্ট্রাল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ও বিক্ষোভের মুখে পড়েন। ইন্দিরা যদিও বলেন, "আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি বজায় রাখা পুলিশের কাজ। পুলিশ সেই চেষ্টাই করছে।" অনশন মঞ্চের সামনেও সেইসময় ভিড়ের চাপে দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভিড়ের মধ্যেই দেখা যায় অপর্ণা সেন, চৈতি ঘোষালদের। বিকেল থেকেই অবশ্য অনশন মঞ্চের সামনে ভিড় বাড়ছিল। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, ধর্মতলার অনশনমঞ্চ, ধর্মতলা মোড় ছাপিয়ে ক্রোধ, প্রতিবাদ আর চোখের জলের যে ভিড় ঢেউয়ের মতো মিলেমিশে জোয়ার তৈরি করেছিল গোধূলি থেকেই, প্রাক- কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ যার সাক্ষী।




অনশনরত ডাক্তাররা: 

ডাক্তারদের এই অনশন চলছে,সাধারণ জনগণ ওনাদের পাশে আছে।যথা সাধ্য চেষ্টা সবাই করে যাচ্ছেন। সমস্ত ডাক্তারদের জানাই কুর্নিশ।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতা:

দ্রোহ কার্নিভাল ২০২৪ শুধু একটি দিনের ঘটনা ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের প্রতীক। এই আন্দোলন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে একটি জাগরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই আন্দোলনটি কেবল আরজি করের ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং রাজ্যের চিকিৎসক সমাজের নানা সমস্যার প্রতিফলন ঘটায়।

উপসংহার:

২০২৪ সালের পুজো কার্নিভাল শুধু আনন্দ এবং উৎসবের ছিল না, তা এক দ্রোহের বার্তাও বয়ে এনেছিল। দ্রোহ কার্নিভাল চিকিৎসকদের জন্য একটি নতুন মঞ্চ তৈরি করেছে যেখানে তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং সঠিক কর্ম পরিবেশের দাবিতে একত্রিত হতে পেরেছে।প্রকৃতপক্ষে দ্রোহ কার্নিভালের সামনে সব কার্নিভাল ফিকে হয়ে গেছে।প্রকৃতই - "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"


  


                                       

Friday, October 11, 2024

Embracing Goodbyes: The Poignant Journey of Bijaya Dashami in Durga Puja

 বিজয়া  দশমী, যা বাংলার অন্যতম মহিমান্বিত দিন, দুর্গা পূজার শেষ দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। এটি দেবী দুর্গার বিদায়ের দিন, যখন তিনি কৈলাসে ফিরে যান। বিজয়া দশমী শুধু দুর্গা পূজার পরিসমাপ্তি নয়, এটি শুভ শক্তির অশুভ শক্তির ওপর বিজয়ের প্রতীকও বটে। মহিষাসুর নামক রাক্ষসের বিনাশ এবং শুভ শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গা এই দিনকে স্মরণীয় করে তুলেছেন।

 দশমীর পুরাণ-ভিত্তিক ইতিহাস:

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুর এক অমর রাক্ষস ছিল যাকে দেব-দেবতা সকলেই পরাস্ত করতে ব্যর্থ হন। এরপর, দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে সৃষ্টি হয় দেবী দুর্গা। দশ দিন ধরে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে দশম দিনে তিনি তাকে বধ করেন। সেই দিন থেকেই বিজয়া দশমী দেবীর বিজয় উদযাপনের দিন হিসেবে পালন করা হয়। দেবীর এই বিজয় আসলে দুষ্টের দমন ও সৃষ্টির নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিজয়া দশমীর মাধ্যমেই মানুষের মনে নতুন করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা হয় এবং অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে।

কেনো বিজয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়:

বিজয়া শব্দটির সঙ্গে মা দুর্গার মহিষাসুর বধের সাথে সাথে আরো একটি কাহিনী রয়েছে। রামচন্দ্র রাবণকে পরাজিত করার জন্যে যে অকাল বোধন করেছিলেন ষষ্ঠীর দিন শুরু সেই অকাল বোধনের শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর দিন রামচন্দ্র রাবণের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন। তাই বিজয়া দশমী বা দশেরা।

বিজয়া দশমীর আচার-অনুষ্ঠান:

দুর্গা পূজার প্রথম থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিটি দিনেই নানা আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, কিন্তু বিজয়া দশমীর দিনটি সবচেয়ে আবেগময়। এই দিনে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানো হয়, যা “দুর্গা বরন” নামে পরিচিত।একে একে সকল মহিলারা মাকে পান,মিষ্টি,প্রদীপ দিয়ে বরণ করে। বিবাহিত নারীরা দেবী দুর্গার কপালে সিঁদুর লাগান এবং একে অপরকে সিঁদুর খেলা করেন। এই আচার নারীদের দীর্ঘজীবন, মঙ্গল, এবং শুভ কামনার প্রতীক। সিঁদুর খেলার মাধ্যমে নারীরা একে অপরের মঙ্গল কামনা করেন এবং দেবীকে শুভ বিদায় জানান। এর পর শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের পালা, যা সাধারণত নদী বা জলাশয়ে সম্পন্ন হয়। বিসর্জন পর্বটি দেবীকে পুনরায় তাঁর স্বর্গীয় বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার প্রতীকী রূপ।




                        

সিঁদুর খেলার কারণ:

দশমীর দিন যে রীতির জন্য বাঙালি নারী অপেক্ষায় থাকে, সেটি হল সিঁদুর খেলা। সিঁদুর ব্রহ্মার প্রতীক। ব্রহ্মা জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর করে আনন্দে ভরে রাখেন বলেই হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়।ললাটে বা ভাগ্যস্থানে তিনি যাতে অধিষ্ঠিত থাকেন, তাই সিঁদুর পরার রীতি। মায়ের বিদায়বেলায় তাই স্বামীর মঙ্গল চেয়ে সিঁদুর খেলা। এখনও স্বামী বা বাড়ির কেউ কাজের জন্য বাইরে গেলে মা-কাকিমারা ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলেন। দুর্গতিনাশিনীকে স্মরণ করার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সিঁদুরের মাহাত্ম্য।অন্যদিকে লাল রঙটি পুরাণ মতে উর্বরতা, প্রেম ও আবেগের প্রতীক। তাই এয়ো স্ত্রীদের আচার অনুষ্ঠানে লাল রঙটি বারবার ফিরে আসে‌। লালপাড় সাদা শাড়ি। সাদা শাঁখা, লাল পলা। দশমীতে মা ফিরছেন তাঁর স্বামীর কাছে। তাই মাকেও লাল রঙে রাঙিয়ে বিদায় জানানোর রীতি প্রচলিত।অন্যদিকে একটি লৌকিক বিশ্বাসও রয়েছে দশমীর এই রীতি ঘিরে। মা দুর্গা তো আদতে বাড়ির মেয়ে। বাড়ির মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর আগে মিষ্টিমুখ করাতে হয়‌। এরপর সিঁদুর ও আলতা পরিয়ে বিদায় জানানোর রীতি রয়েছে। সেই রীতিই মেনে চলা হয় বিজয়া দশমীতে‌।

বিজয়া দশমীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য:

বিজয়া দশমী কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনেরও দিন। বিজয়া দশমীর সময় ছোটরা বড়দের প্রণাম করে, এবং বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ দেন। একে অপরকে আলিঙ্গন করে “শুভ বিজয়া” বলে অভিবাদন জানানো হয়। এই উৎসব মিষ্টিমুখ করে উদযাপিত হয় এবং নতুন করে সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে তোলে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবার পরিজনের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।


     

বিজয়া দশমী এবং বাঙালির আবেগ:

বিজয়া দশমী শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির মনের গভীরে প্রোথিত এক আবেগের উৎসব। দেবীর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি শূন্যতা এবং বিষণ্নতা ঘিরে ধরে।মায়ের বিদায়ের বেলায় সকলের চোখের কোনা জলে ভরে ওঠে, বুকের  ভেতরে সৃষ্টি হয় এক শূন্য স্থান।মা এর প্রতিমা দেখলে মনে হয় মা নিজেও কাঁদছেন।হয় বিসর্জন এই বলে - "আসছে বছর আবার হবে।"এই বলে একই সঙ্গে আগামী বছরের পূজার জন্য নতুন আশা জাগ্রত হয়। এই দিনটি বাঙালিদের জন্য বিশেষ, কারণ এটি শুধুমাত্র পূজার সমাপ্তি নয়, এটি তাঁদের সামাজিক বন্ধনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। বাড়ি বাড়ি বিজয়ার মিষ্টিমুখ করতে যাওয়া, মিষ্টি বিতরণ করা, এবং একে অপরের সঙ্গে দেখা করা—এই সব কিছু মিলে বিজয়া দশমী বাঙালির জীবনে এক অনন্য আবেগের দিন হিসেবে পালিত হয়।

এভাবেই, বিজয়া দশমী শুভ শক্তির বিজয়, সামাজিক সংহতি, এবং নতুন শুরুকে চিহ্নিত করে।




Thursday, October 10, 2024

The Significance of Durga Ashtami and Sandhi Puja: A Sacred Union of Power and Devotion

 দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথি হল পঞ্চম দিনের পূজা, যা শক্তির মহিমা ও ভক্তির মিলন ঘটায়। অষ্টমীকে দুর্গাপূজার অন্যতম পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে ধরা হয়, কারণ এই দিনে দেবী দুর্গার মহা গৌরবময় রূপের পূজা হয়। সকাল থেকেই পূজার্চনা, অঞ্জলি, এবং ভোগ নিবেদন শুরু হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো কুমারী পূজা, যেখানে কুমারী বালিকাকে দেবীর রূপে পূজা করা হয়।




 

অষ্টমীর পৌরাণিক গুরুত্ব: 

এই অষ্টমীটি রয়েছে এক পৌরাণিক গুরুত্ব মনে করা হয় যে এই অষ্টমী তিথিতেই মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। তাই এই দিন ভক্তরা পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে দেবীর আরাধনা করেন।

অষ্টমীর গুরুত্ব:

অষ্টমী তিথি দুর্গাপূজার বিশেষ আকর্ষণ। এই দিনে ভক্তেরা পূর্ণভাবে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অষ্টমীর অঞ্জলিতে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, এবং ঢাকের বাজনা যেন ভক্তদের মনোযোগ আর ভক্তিকে দেবীর চরণে নিবেদন করে। দেবী চামুণ্ডার মহাশক্তির পূজা হয় এই দিনে।

সন্ধি পূজার পৌরাণিক কাহিনী: 

পুরাণ মতে বলা হয় যে মা দুর্গা এক অপরূপ সুন্দরী নারীর বেশে মহিষাসুরের সামনে এসেছিলেন। দেবীর দশ হাতে ছিল দশটি অস্ত্র। গায়ের বর্ণ ছিল স্বর্ণাভ। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন মহিষাসুরের দুই সহজাত পেছন থেকে দেবীকে আক্রমণ করেন। সম্মুখে যুদ্ধ না হওয়ায় রেগে যান মহামায়া। রেগে দেবীর মুখ হয়ে ওঠে নীলাভ। মহামায়া ক্রধান্বিত হয়ে চামুন্ডা রূপ ধারণ করেন। এইরূপে দেবী মহিষাসুরের দুই সহযাত চন্ড ও মুন্ডের মাথা কেটে নেন। দেবীর এই চামুন্ডা রূপেরই পুজো করা হয় সন্ধি পূজার সময়। এই পূজার মূল আকর্ষণ হল যখন দেবী দুর্গা দেবী চামুণ্ডার রূপ ধারণ করেন এবং অসুরদের বিনাশ করেন। শাস্ত্র অনুযায়ী, মহিষাসুরকে বধ করার সময় সন্ধি পূজার এই মুহূর্ত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।মা দুর্গার অনেকগুলি রূপের মধ্যে অন্যতম হলো মহিষাসুরমর্দিনী। মহিষাসুরকে বধ করে তিনি হয়েছেন মহিষাসুরমর্দিনী। যার সঙ্গে যোগ রয়েছে সন্ধিপুজের।


                             

সন্ধি পূজা: দুটি তিথির সন্ধিক্ষণ:

সন্ধি পূজা হল অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে করা বিশেষ পূজা, যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মহিমাময়। সন্ধি পূজা হয় অষ্টমী শেষের ২৪ মিনিট এবং নবমী শুরুর ২৪ মিনিট, মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে। এই সময় দেবীর ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং ১০৮টি পদ্মফুল দিয়ে পূজা করা হয়। ভক্তরা মনে করেন, এই সময়ে দেবীর আশীর্বাদ পাওয়া সব থেকে শুভ।


সন্ধি পূজার ঐতিহ্য ও রীতি:

সন্ধি পূজায় সাধারণত ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীকে আহ্বান করা হয় এবং তাঁর কাছে ভক্তি নিবেদন করা হয়। অনেক পরিবার ও মণ্ডপে বলির প্রথাও মানা হয়। যদিও আজকাল বলির পরিবর্তে সবজি বা ফলের বলি দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত হয়েছে। সন্ধি পূজা দেবীর অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক হিসেবে উদযাপন করা হয়, যা ভক্তদের নতুন শক্তি ও আশীর্বাদ প্রদান করে।

১০৮ প্রদীপ ও ১০৮ পদ্ম এর ইতিহাস:

কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে উল্লেখ আছে লঙ্কার রাজ রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্র দেবীর অকালবোধন করেছিলেন। সেখানেও সন্ধি পুজোর বিশেষ খনে ১০৮ টি পদ্ম নিবেদন করা হয়েছিল। সেই সময় হনুমানকে ১০৮ টি পদ্ম তুলে আনতে বলা হয়, কিন্তু পুজোর সময় রামচন্দ্র দেখছেন ১০৭ পদ্মফুল পড়ে রয়েছে। একটি পদ্ম না পেয়ে রামচন্দ্র নিজের পদ্মসম চোখ মা দুর্গাকে উৎসর্গ করতে চান। আসলে একটি পদ্ম সরিয়ে নিয়েছিলেন মা নিজেই। যখন রামচন্দ্র নিজের চোখ উৎসর্গ করতে যান তখনই আবিভূত হন মা দূর্গা। তিনি আবির্ভূত হয়ে রামচন্দ্রকে বর দান করেন যে তিনি রবনের থেকে সমস্ত সুরক্ষা সরিয়ে নেবেন। ষষ্ঠীর দিন রামচন্দ্র পূজা শুরু করেন, অষ্টমী ও নবমী তিথির মাঝে রামচন্দ্রের অস্ত্র প্রবেশ করে, দশমীতে হয় রাবণ বধ। সেই সময় থেকে সঞ্জীব পুজোর মূল নৈবেদ্য হলো পদ্ম। তাই জন্য ১০৮  টি পদ্ম, ১০৮ বেলপাতা ও ১০৮ প্রদীপ পুজোতে ব্যবহার করা হয়।


                    

উপসংহার:

দুর্গা অষ্টমী এবং সন্ধি পূজা বাঙালির হৃদয়ে এক বিশাল স্থান অধিকার করে আছে। দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয় যাতে তিনি জীবনের সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভের বিজয় ঘটান। শক্তি, ভক্তি এবং মহিমার এই পূর্ণতা উপলব্ধি করাই অষ্টমী ও সন্ধি পূজার মূল উদ্দেশ্য।





Wednesday, October 9, 2024

The Significance of Nabapatrika: A Ritual of Durga Saptami

 বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গোৎসব। আমরা যাকে দুর্গোৎসব বলি অবাঙালিরা তাকেই নবরাত্রি বলে। এই নবরাত্রি সূচনা হয় মহালয়ার পরের দিন থেকেই এবং শেষ হয় আমাদের দশমী অর্থাৎ অবাঙালিদের দশেরার দিন। দুর্গা পূজার প্রত্যেক দিনেই রয়েছে অনেক নিয়ম ও আচার। দুর্গাপূজা প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় সপ্তমীর দিন থেকে। এই সপ্তমীর সূচনা হয় নবপত্রিকা স্নান দিয়ে। 





নবপত্রিকা প্রকৃতপক্ষে কি?


নবপত্রিকা মা দুর্গার এক বিশেষ অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির অর্থ হলো নয়টি গাছের পাতা। প্রকৃতপক্ষে পাতা নয় পুরো গাছটিকে প্রয়োজন হয়। নবপত্রিকার জন্য যে যে গাছগুলি প্রয়োজন হয় তা হল-


         ১. কদলী বা রম্ভা (কলা): 

         ২. কচু :

         ৩.হরিদ্রা(হলুদ):




         ৪.জয়ন্তী:

         ৫. বেল:

         ৬. দারিম্বো (ডালিম):

         ৭. অশোক:

          ৮.মানকচু :

          ৯.ধান:

এই সকল গাছগুলিকে( মূলসহ পাতা রয়েছে)শপত্র কলা গাছের সঙ্গে  স্বমূলে একজোড়া বেলের সাথে সাদা অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এবং তাকে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া হয় অনেকটা নববধূর আদলে। স্ত্রী রূপে তার পূজো হয়। স্ত্রী রূপের সঙ্গে দুটি বেল দিয়ে করা হয় তার স্তন যুগল। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবারে মা দুর্গার সঙ্গে তাকে পূজা করা হয়। দেবী প্রতিমার ডান দিকে দাঁড়িয়ে তার পূজো করা হয়। প্রচলিত ভাষায় এই নবপত্রিকাকে আমরা কলা বউ বলি। প্রকৃতপক্ষে গণেশের স্ত্রী কলা বউ নয়। গণেশের স্ত্রী এর নাম হল রিদ্ধি এবং সিদ্ধি। গণেশের দুই পুত্র রয়েছে যারা হলেন শুভ ও লাভ। 





নবপত্রিকা পুজোর মূল কারণ:


প্রকৃতপক্ষে এই নবপত্রিকার মাধ্যমে মা দুর্গার ৯ টি রূপের পূজা হয়।

        এই নবপত্রিকার  রূপগুলি হল -

কাদলি বা রম্বা বা (কলাগাছ): কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রাহ্মণী।

 কচু: কচু গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা। 

হরিদ্রা বা হলুদগাছ:  এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা।  

 জয়ন্তী গাছ: জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী। 

বেল গাছ:বেল গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা

 ডালিম গাছ:ডালিম গাছের অধিক ধাত্রী দেবীর রক্তদণ্ডিকা

 অশোক গাছ:অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা

 মানকচু গাছ: এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর চামুণ্ডা

      

ধান গাছ: ধান গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী 


মা দুর্গার এই নয় রূপের পূজা হয় কলা বউ অর্থাৎ নবপত্রিকার মাধ্যমে যেটি ছাড়া দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ। মহা সপ্তমীর দিন সকালবেলায় কাছাকাছি অবস্থিত কোন নদী বা জলাশয় নিয়ে যাওয়া হয় নবপত্রিকাকে স্নান করানোর উদ্দেশ্যে। পুরোহিত নিজের কাঁধে করে নবপত্রিকাকে নিয়ে যান। তার পেছনে ঢাকি তার ঢাক বাজাতে বাজাতে যান, তার সঙ্গে থাকে মহিলাদের শঙ্খ ও উলুধ্বনির শব্দ। শাস্ত্র বিধি অনুসারে স্নান করানোর পরে নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয় ও পূজা মন্ডপে নিয়ে এসে দেবীর ডানদিকে একটি কাঠের সিংহাসনের উপর তাকে স্থাপন করা হয়। মণ্ডপে কলা বউ প্রবেশের মাধ্যমে শারদীয়ার প্রথাগত সূচনা ঘটে। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। বাকি দিনগুলোতে নবপত্রিকাকে অন্যান্য দেবদেবীর ন্যায় পুজো করা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের আগে নবপত্রিকার সামনে দেবীকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়। আসলে মা দুর্গার প্রতীক হিসেবে নব পত্রিকার মাধ্যমে শস্য বধূকেই দেবীর প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং প্রথমে তার পূজো হয়। কারণ শারদীয়ার দুর্গাপূজার  মূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পুজো প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে দুর্গাপুজোর অন্যান্য নিয়মের সঙ্গে নবপত্রিকার স্নান এবং তার পূজো একাত্ম হয়ে গেছে। 







   শেষ পর্যন্ত দেখতে গেলে বিষয়টি হলো যে মা দুর্গা এবং শস্যদেবী একসঙ্গে মিশে গেছে। এই শস্য মাতা পৃথিবীর রূপভেদ। আমাদের দুর্গাপুজোর ভেতর দিয়ে আমরা সেই আদিমাতা পৃথিবীর পুজো করি|

দুর্গা পূজার মহাসপ্তমী বাংলা সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন।  সপ্তমীতে প্রান প্রতিষ্ঠা হয়, যার মাধ্যমে দেবী দুর্গার মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি দেবীর পৃথিবীতে আগমন এবং মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা নির্দেশ করে, যা মন্দের  ওপর ভালোর জয়ের প্রতীক। সপ্তমীর মাধ্যমে পূজার মূল আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয়, যা পরবর্তী অষ্টমী এবং নবমীর সময় আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়। এই মহা সপ্তমীর বিশেষ ক্ষণে সবাইকে জানাই-"শুভ মহাসপ্তমী"






Psychological Flow While Reading Books: Exploring the Reader's Journey Through Bengali And English Classics and Poetry

  বই পড়ার সময় মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ: বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব এবং পাঠকদের মানসিক জগৎ ভূমিকা: বই পড়া মানেই কেবল গল্প বা জ্ঞান আহরণ ন...