Sunday, September 29, 2024

The History Of Surul Sarkar Rajbari



শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন

শান্তিনিকেতনের মাটি যেমন রবি ঠাকুরের কাব্যের আলোয় উদ্ভাসিত, তেমনি এই মাটিতে বছরের পর বছর ধরে নানা পারিবারিক পূজা ও উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আমার বাড়ি অর্থাৎ সুরুল সরকার রাজবাড়ীর দুর্গাপূজা এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য।


পূজা ইতিহাস: এক শতাব্দীর পুরানো গল্প



সুরুল সরকার বাড়ির দুর্গাপূজা শান্তিনিকেতনের প্রাচীন পূজাগুলির মধ্যে অন্যতম। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ভরত চন্দ্র সরকার সস্ত্রীক বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে সুরুলে চলে আসেন। তারা ছিলেন নিঃসন্তান।গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে তারা সুরুল এই পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেন ।গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে প্রতিনিয়ত শ্যামসুন্দরের পুজো হতো। মনে করা হয় যে ভরত চন্দ্র সরকারও সুন্দরের পুজো করার পরেই পুত্র লাভ করেনএবং যার নাম ছিল কৃষ্ণহরি । এই পরিবারের আসল পদবী সরকার নয়, প্রকৃত পদবী ঘোষ। কৃষ্ণহরি ইংরেজদের সঙ্গে নীল চাষ করার পরে পরিবারের যথেষ্ট পরিমাণে শ্রী বৃদ্ধির ঘটেছিল। শ্রীনিবাস প্রথম বানিয়েছিলেন সূরুলে পাঁচচালা মন্দির সেই সময় মোট খরচ হয়েছিল ১৮০০০ টাকা। কৃষ্ণহরির মৃত্যুর পর কৃষ্ণহরির তিন সন্তান যাদবেন্দ্র, মাধবেন্দ্র ও কালীচরণের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে ভীষণ কলহলের সৃষ্টি হয়। যাদবেন্দ্র ও কালীচরণ একসাথে আদি বাড়িতে থাকতে শুরু করেন যা বড় সরকার বাড়ি নামে পরিচিত এবং মাধবীেন্দ্র পাশে বাড়ি করেন যা এখন ছোট সরকার বাড়ি নামে পরিচিত।প্রায় এক শতাব্দী ধরে, এই পূজা শুধুমাত্র পরিবারের নয়, পুরো এলাকার মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শান্তি ও সৃজনশীলতার প্রাঙ্গণে এই পূজার সূচনা হয়েছিল রামকৃষ্ণ সরকারের আমলে, যিনি ছিলেন পরিবারের পিতৃপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তখন থেকেই দেবী দুর্গাকে শান্তির প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়।দুর্গামন্দিরের গর্ভগৃহে বছরভর কাঠামোতে জড়ানো খড়ের প্রতিমা দেখা যায়। এই বাঁশ-কাঠের কাঠামো হচ্ছে নিরঞ্জনের পরে জল থেকে তুলে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই অবস্থাতে নিত্যপূজ্যও। প্রতি বছর রথযাত্রার দিন ওই কাঠামোতে পুরানো বিচালি ফেলে দিয়ে নড়বড়ে অবয়ব সযত্নে মেরামতি করে আসন্ন শারদীয় দুর্গামাতার মৃণ্ময় মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়।


পূজার আচার ও অনুষ্ঠান



পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত চলতে থাকা এই পূজার সময় বাড়ির সদস্যরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে মেতে ওঠেন। সপ্তমীর দিন সকালবেলা যে দোলাই করে আনা হয় নবপত্রিকাকে। তারপর শুরু হয় মহাউৎসব। সপ্তমের সকালে হয় চাল কুমড়ো বলি। পুরোহিতরা যখন পূজারতি করেন, তখন রঙিন বিশালাকায় নকশা করা তালপাতার হাত পাখায় বাতাস দেওয়ার রীতি। তারপরে চামর দুলিয়ে আরতি‌। ব্রাহ্মণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সকল ছেলে এবং মেয়েরাও মাকে চামড় দিয়ে বাতাস করেন। মহাষ্টমীতে শুরু রাজবাড়ীর রুপ বদলে যায়। অন্যান্য রাজবাড়ীর মতো এই বাড়িতে কোন কুমারী পুজো হয় না। সন্ধি পুজোর খানে এখানে হয় পাঁঠা বলি। এই সময় মা এর চোখ দেখে মনে হয় মা জাগ্রত অবস্থায় আপনাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে অপরূপ অভিজ্ঞতা, শব্দ দিয়ে হয়তো তাকে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বলা হয় সন্ধি পূজোর ক্ষানে যখন পাঠা বলি হয় মায়ের মুখের দিকে তাকাতে নেই ,মা তখন হয়ে ওঠে রণচন্ডী।সাথে ঢল,সানাই আর উলুধ্বনির প্রতিধ্বনি।


 নবমীর সকালবেলাতে হয় আখ বলি ও হোম।


 নবমী পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যাতেই চলে ঢোল সানাইয়ের সঙ্গে নৃত্য।দশমীর সকালবেলাতে সমস্ত বাড়ির মেয়েরা পরে শাড়ি এবং ছেলেরা পড়ে ধুতি পাঞ্জাবি।দশমীর দিন বেলার দিকে বেলপাতার মধ্যে খাগের কলমে ‘শ্রীশ্রীঁদুর্গামাতা সহায়’ লিখে এক টাকার মুদ্রা সমেত মুড়ে ওই পাতা পুরোহিতের হাতে দেওয়ার চল। এতে প্রচুর মানুষের উৎসাহের কারণে নারী-পুরুষের আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়‌ খানিক। পুরুত ঠাকুরেরা দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে সেই মুদ্রা ফেরত দিলে মাঙ্গলিক বস্তু হিসেবে সেটা ঘরে রেখে দেওয়া রীতি। লতা সহ অপরাজিতা ফুলগাছের পাতা পুজো দিয়ে বিতরণ করা হয়ে থাকে। ওই লতা-পাতা কব্জিতে বাঁধা শুভ। তারপরেই শান্তি-জল ছিটিয়ে দেওয়া ও তা মাথা নত করে শরীরে ধারণ করা। এই অনুষ্ঠানের নামও ‘যাত্রা’। শুরু হয়‌ দশমীর দিন বেলা দশটা নাগাদ। এই বাড়ির প্রতিমা বিসর্জন হয় সুরুলের বাকি সমস্ত প্রতিমা বিসর্জনের। শুধু যদি কোন কারণে দশমীর দিন বৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে মায়ের বিসর্জন হয় না কারণ মায়ের গায়ে কোন বৃষ্টির জল পড়া যাবে না। সারা সন্ধ্যে জুড়ে বাড়ির দালানে বসে সকলের মিলে সিদ্ধি দিয়ে তৈরি নারকেল নারু,মিষ্টি লুচি মায়ের প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করে।বিসর্জনের সময় বাড়ির ছেলেদের চলে মশাল নাচ। মশাল হাতে নিয়েই তারা এগিয়ে চলে মায়ের বিসর্জনের উদ্দেশ্যে। মশাল জ্বালিয়ে ভাসানের শোভাযাত্রার আগে প্রতিমাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হয়।বিসর্জনের পূর্বে চলে আতসবাজের প্রদর্শন। অবশেষে মায়ের নিজের পুকুর, কালিসায়রের পুকুরে মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় এই ধ্বনির সাথে- " আসছে বছর আবার হবে!"




পাশাপাশি এক বৃহত্তর মিলন মেলা

বাড়ির পূজোতে বাড়ির সদস্যরা যেখানেই থাকুক না কেন পুজোর সময় সবাই বাড়িতে উপস্থিত হয়।সুরুল সরকারের বাড়ির দুর্গাপূজা শুধুমাত্র পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি শান্তিনিকেতনের সৃজনশীল পরিবেশের সঙ্গে এক অদৃশ্য সেতু গড়ে তোলে। পূজার দিনগুলিতে বাড়ির উঠোনে বসে ছোট ছোট মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসর। সপ্তমী থেকে নবমীর পর্যন্ত চলে সরকার বাড়ির দালানে যাত্রা। পুজোর ক’দিনের পরিবেশটাই অন্যরকম। আটপৌরে রাজবাড়ির আদলটা বদলে যায়। বাইরে মেলা বসে। ফুচকা, পাপড়ি চাট, ঘুগনি, আলু কাবলি থেকে হরেক ফাস্ট ফুড। ছোটদের খেলনা থেকে মেয়েদের সাজের জিনিসের দোকান। তার সঙ্গে নাগরদোলাও থাকে।সব মিলিয়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এটি সকলের মিলন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।


সুরূল সরকার বাড়ির সদস্য হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা

সূরুল সরকার বাড়ি সদস্য হিসেবে বলতে গেলে আমার দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুজো এটি। আমার বাবার কর্মক্ষেত্রের জন্য আমি খড়গপুরে থাকি।তাই আমি বারোয়ারি পূজো ও নিজের বাড়ির পুজোর মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে তা অনুভব করতে পারি। এখানে সপ্তমীর সন্ধ্যের আরতি, অষ্টমীর দিন মায়ের অপরূপ রূপ, নবমীর দিন মাকে চামরে হাওয়া দেওয়া, দশমীর বিসর্জন সব মিলিয়ে আমার কাছে হয়তো আমার বাড়ির পুজোটাই শ্রেষ্ঠ।



Psychological Flow While Reading Books: Exploring the Reader's Journey Through Bengali And English Classics and Poetry

  বই পড়ার সময় মনস্তাত্ত্বিক প্রবাহ: বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব এবং পাঠকদের মানসিক জগৎ ভূমিকা: বই পড়া মানেই কেবল গল্প বা জ্ঞান আহরণ ন...