বাংলার ঋতুচক্র: বসন্তের ফুল ফুটলো থেকে বর্ষার নীল রঙ
ভূমিকা
বাংলার ঋতুচক্র প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য রূপের সাক্ষী। এখানে প্রতিটি ঋতু যেন এক-একটি গল্প, এক-একটি আবেগ। বসন্তের রঙিন প্রভাত থেকে বর্ষার সিক্ত বিকেল পর্যন্ত প্রতিটি ঋতু বাংলার জনজীবন ও সংস্কৃতিতে এক অনন্য প্রভাব ফেলে। ঋতুর পালাবদলে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় মানুষের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, এমনকি চিন্তাভাবনার ধারা।
বসন্ত: বসন্ত আসে রাজবেশে। ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। বসন্ত নিয়ে আসে ফুলের সমারোহ। বাতাসে ভেসে বেড়ায় মৌ মৌ ফুলের সুবাস। গাছে গাছে কোকিল-পাপিয়ার সুমধুর গান। দখিনা বাতাস বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ। মানুষের প্রাণে বেজে ওঠে মিলনের সুর। আনন্দে আত্মহারা কবি গেয়ে ওঠেন—
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়৷
প্রকৃতির বিবরণ
গাছে গাছে নতুন পাতা, কৃষ্ণচূড়া ও শিমূলের লাল-কমলা ফুল।
বসন্ত বাংলার প্রকৃতিতে যেন এক নীরব বিপ্লব আনে।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
বসন্ত উৎসব, দোলযাত্রা।
রবীন্দ্রসংগীতের সুরে "ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়" যেন জীবনের আনন্দ প্রকাশ পায়।
মানুষের জীবনযাত্রা
হালকা পোশাক, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার।
খাবারে পিঠে-পুলি ও পাটিসাপটার চাহিদা।
গ্রীষ্ম:গ্রীষ্ম ঋতুর মধ্য দিয়েই প্রকৃতির যাত্রা শুরু হয়েছে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস গ্রীষ্ম ঋতুর অধীন। সূর্যের প্রচন্ড তাপ প্রবাহের ফলে পৃথিবীতে নেমে আসে মরুভূমির কঠিন কঠোর শুষ্ক আবহাওয়া। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়-
দারুণ অগ্নিবানে হৃদয় তৃয়া হাতে রজনী নিদ্রাহীন দীঘ দগ্ধ দীন”।
প্রকৃতির এই দগ্ধতা মৃদুমন্ত বাতাস অনেকটাই কমিয়ে দেয়। এই সময় কালবৈশ পীর ঝড় তার প্রচন্ড ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠলেও তার মধ্যেই আমরা শুতে পায় সৃষ্টিসুখের গোপন বার্তা। ফুল ফোটানোর এই ঋতুর দায়িত্ব নয়। ফল ফলানোতেই তার আনন্দ । গ্রীষ্ম তাই ফলের ঋতু। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি রসালো ফলে প্রকৃতির ডালি এই সময় পূর্ণ থাকে
প্রকৃতির বিবরণ
ঝলসানো রোদে মাটি যেন ফেটে চৌচির।
কাঁঠাল, আম, লিচু গাছে গাছে ফলের রাজত্ব।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
পল্লীগ্রামে "আম কাঠাল" উৎসব।
রবি ঠাকুরের "তৃষ্ণা দাহ" কবিতায় গ্রীষ্মের ছোঁয়া।
মানুষের জীবনযাত্রা
গামছা, পাখা, এবং "ঘোল" বা দই পানির তৃষ্ণা নিবারণ।
মাটির কলসিতে ঠাণ্ডা জল।
বর্ষা: "ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে / জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা / শ্যামগম্ভীর সরসা ।"
ঋতু পর্যায়ের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা । আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস নিয়ে বর্ষাকাল । বর্ষা আসে আপন মহিমায়, ঘনঘন বিদ্যুতের চমকে আর অনবরত বারিধারায় আমরা জানতে পারি বর্ষারাণীর আগমন বার্তা । বর্ষার পুতধারায় বাংলার খাল, বিল, নদী,নালা ভরে ওঠে কানায় কানায় । প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনও নেচে ওঠে । বাংলার কৃষকের প্রাণেও জাগে নবীন সুর ও আশা । কেন না বর্ষা ফল ও ফসলের ঋতু, ধান রোপনের ঋতু । বাংলার জলে, স্থলে, বনতলে নবীন কিশলয়ে লাগে প্রাণের দোলা । তারপর পথে পথে কদম্ব কেশরের স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে বিদায় নেয় বাঙালীর প্রাণের ঋতু বর্ষা ।
প্রকৃতির বিবরণ
ধানখেতে জল জমে, কদম ও শিউলির গন্ধে বাতাস ভরে যায়।
মেঘের গর্জন আর বৃষ্টির ছন্দ যেন প্রকৃতির গান।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
বর্ষা ঋতু বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে।
রবীন্দ্রনাথের "বর্ষা মঙ্গল" এবং জীবনানন্দের "বনলতা সেন"-এ বর্ষার নানান রূপ ধরা পড়ে।
মানুষের জীবনযাত্রা
খিচুড়ি-ইলিশের যুগলবন্দি।
ছাতা, রেইনকোট এবং কাদা মাড়ানোর স্মৃতি।
শরৎ: বর্ষা বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আগমন হয় শরৎ । বাংলার ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস নিয়ে শরৎকাল । একে পূজার ঋতুও বলা হয় । প্রকৃতিতে সজো সাজো রব দেখেই বোঝা যায়, শরতের আগমন । নীল আকাশের মাঝে মাঝে পেঁজা ধবধবে সাদা তুলোর মতো মেঘের ভেসে বেড়ানো ।
"আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা ।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা "
প্রকৃতির বিবরণ
আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, মাঠে কাশফুল।
শারদীয়া হাওয়ার নরম পরশ।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
দুর্গাপুজো, মহালয়া।
"যা দেবী সর্বভূতেষু" মন্ত্রধ্বনির মাঝে শরৎ যেন এক মহোৎসব।
মানুষের জীবনযাত্রা
নতুন জামাকাপড়, বাড়ির সাজসজ্জা।
পূজোর আনন্দে মেতে ওঠা।
তাই তো কবি গেয়েছেন—
আজিকে তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
শরতের এই অপরূপ রূপের জন্যই শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানি।
হেমন্ত: শরতের আনন্দের রেস কাটতে না কাটতে প্রকৃতিতে হেমন্তের উদয় হয় । কুয়াশার চাদরে মুড়ি আসে হেমন্ত । কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু । ফসল পাকানোর পালা চলে । ফসল তোলা হয় এই সময় । কৃষকের ঘরে ঘরে ফসল কাটার আনন্দের সঙ্গে পালিত হয় নবান্ন উৎসব ।ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবের আনন্দ নিয়ে আগমন ঘটে হেমন্তের। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ হলুদ। শর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের বুক। মাঠে মাঠে পাকা ধান। কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফসল কাটার কাজে। সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, মুখে ফোটে আনন্দের হাসি । শুরু হয় নবান্নের উৎসব। হেমন্ত আসে নীরবে; আবার শীতের কুয়াশার আড়ালে গোপনে হারিয়ে যায়।
প্রকৃতির বিবরণ
মাঠে পাকা ধানের সুবাস।
শীতের আমেজ নিয়ে হেমন্তের আগমন।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
"নবান্ন উৎসব", ধান কাটার পর বাড়িতে নতুন চালের পিঠে-পুলি।
বাউলগানের মিষ্টি সুর।
মানুষের জীবনযাত্রা
শীতের প্রস্তুতি, নতুন চাদর কেনা।
সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের উঠানে আলাপচারিতা।
শীত: কুয়াশার চাদর গায়ে উত্তরের হাওয়ার সাথে আসে শীত। পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল। শীত রিক্ততার ঋতু। কনকনে শীতের দাপটে মানুষ ও প্রকৃতি অসহায় হয়ে পড়ে। তবে রকমারি শাক-সবজি, ফল ও ফুলের সমারোহে বিষণ্ন প্রকৃতি ভরে ওঠে। বাতাসে ভাসে খেজুর রসের ঘ্রাণ। ক্ষীর, পায়েস আর পিঠা- পুলির উৎসবে মাতোয়ারা হয় গ্রামবাংলা|
প্রকৃতির বিবরণ
কুয়াশায় মোড়া সকাল, জমির উপর শিশির বিন্দু।
নানান রকমের ফুলের সমারোহ।
সংস্কৃতির ছোঁয়া
পৌষ মেলা, গঙ্গাসাগর মেলা।
শীতের রাতে কাব্য ও সাহিত্যচর্চার পরিবেশ।
মানুষের জীবনযাত্রা
মোটা পোশাক, কম্বল, আর আগুনের তাপ।
গুড় ও দুধের মিষ্টি পিঠের স্মৃতি।
উপসংহার
বাংলার ঋতুচক্র শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নয়, মানুষের জীবনযাত্রার সাথে গভীরভাবে জড়িত। প্রতিটি ঋতু বাংলার কাব্য, সঙ্গীত, এবং সংস্কৃতির এক অনন্য রূপ প্রকাশ করে। বসন্তের রঙ, গ্রীষ্মের দহন, বর্ষার সুর, শরতের পুজো, হেমন্তের ধানের ঘ্রাণ, এবং শীতের কুয়াশা—সবই একসাথে মিলে বাংলার ঋতুচক্রকে এক অতুলনীয় সৌন্দর্য দেয়। প্রকৃতির এই অসাধারণ বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা এবং এর সৌন্দর্য অনুভব করা আমাদের সকলের কর্তব্য।